গল্প ও অণুগল্প

যোগ বিয়োগ



প্রিয়াঙ্কা পালিত


একপশলা ভারী বৃষ্টি থামার শেষে দোকানটার সিড়ি থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছি, আকাশ থেকে তখনও কিশোরীর অভিমানী মনের ভাবধারার মতো ঝরে চলেছে সূক্ষ্ম বারিকণা, হঠাৎই দ্বিতীয় সিড়ির একেবারে কোণায় চোখে পরলো একখানা ছোট জেন্টস্ হ্যান্ডব্যাগ, জলে-কাদায় খানিক মাখামাখি, খুব পুরোনো নয় ওটা, মনে খানিক ভয় মিশ্রিত বিরক্তি তৈরী হল। এসব অযাচিত ব্যাগ বা কৌটো থেকেই বোম ফেটে কত মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছে কিংবা এমন ব্যাগ থেকেই পাওয়া যায় কোন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য।

এসবই ভাবছি এমন সময় হন্ততন্ত হয়ে প্রায় দৌঁড়তে দৌঁড়তে এগিয়ে এলেন পুরোদস্তুর ভিজে যাওয়া এক বয়স্ক ব্যক্তি। ভীষণ তাড়াহুড়োয় সিড়ির এপাশ-ওপাশ চোখ বুলিয়ে নিভে আসা মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- বৃষ্টি শুরুর ঠিক আগেই এ দোকানে এসেছিলাম, হাতে কয়েকটা প্যাকেট ছিল, সেগুলো সামলাতে গিয়ে আমার হ্যান্ডব্যাগখানা কোথায় যে পরলো খেয়াল করতে পারছি না মা, তুমি কি সেখানা আশপাশে কোথাও দেখেছ?

আমি খানিক ইতস্তত করে সেই ব্যাগটি দেখিয়ে দিলাম। মানুষ যে এমন করুন সুখের হাসিও হাসতে পারে তা এই প্রথম দেখলাম। উনি বললেন,
- বড্ড উপকার করলে মা।

ইতিমধ্যে ওনার মোবাইলখানা বাজতে শুরু করেছে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে ফোনখানা কানে দিয়ে খুব ধীর গলায় বলে উঠলেন,
- হ্যাঁ রে মা, প্রায় এসেই গেছি, আসলে আমার হ্যান্ডব্যাগটা হারিয়ে গেছিল। ওতেই তো টাকাটা ছিল, দু'লাখ টাকা তো, ভাগ্যিস খুঁজে পেলাম। আর শোন মা, তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের জন্য কিছু সামান্য জামাকাপড় কিনেছি, জানি ওদের পছন্দ হবে না, তবুও মেয়ের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে একটু দিতে-থুতে হয়।

এরপর বুজে আসা গলায় চিরাচরিত পিতৃভাষ্যে বললেন,
- শোন মা, মাথা গরম করে কিছু করিস না যেন, একটু বুঝে মানিয়ে সাবধানে থাকিস রে, এটাই কিন্তু আমার শেষ এফ.ডি. ছিল।

কিছু কিছু পিতৃত্বের ভাড়ার বারবার এমন বিয়োগে পূর্ণ হয় কেন?

শেষের দিকের কথাগুলো আবছা হয়ে এসেছিল আমার কান পর্যন্ত, এগিয়ে এসেছিলাম বেশ কিছুটা রাস্তা। হঠাৎ ভারি অথচ ক্লান্ত যেন ছুটে আসা পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি সেই ভদ্রলোক, ফোন হাতে ছুটে আসার সাথে সাথে কিছু যেন বলতে চাইছেন আমাকেই। দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভীষণ হাঁপিয়ে গেছেন উনি। দ্বন্দ্ব মেশানো ভেজা গলায় বললেন,
- কিছু মনে কোরো না মা, এমন ভাবে তোমায় বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু বিশ্বাস করো ঠিক এই মুহূর্তে আমি কি করব বুঝতেই পারছি না। আমার মেয়ে, বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ি আর স্বামী সকলের কাছেই অত্যাচারিত, অপমানিত। দেনা পাওনা থেকে আমার মেয়ের গায়ের রঙ, শিক্ষা দীক্ষা সব নিয়েই দ্বগ্ধে চলেছে সমানে। আজ যাচ্ছিলাম ওর শ্বশুরবাড়িতেই কিছু জিনিস আর আমার শেষ পুঁজিটুকু দিয়ে ভালো রাখতে মেয়েটাকে। কিন্তু এখন ফোনে মেয়ে বলে কিনা, সে ওবাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। ফিরবে না আর কখনো! এদিকে আমরা অতি মধ্যবিত্ত তার ওপর সমাজ - কি করি বলো তো মা?

বুঝলাম ভদ্রলোকের আর্থ-সামাজিক কষ্ট ব্যাক্তিগত পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে আজ। এই এক সত্যি কেন বারবার ব্যথিত করে আমাদের বারবার। কিসের উন্নতি, কোথায় শিক্ষা? নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে অজানা পরিবেশকে আপন করে নিজেদের প্রাণটুকুর দায় বাঁচতে হয় কেন, কিছু অভাগীকে? বললাম,
- আসুক মেশোমশাই, আপনার মেয়ে অযাচিত সব বাঁধন ভেঙে আসুক। নিজের জীবন বাঁচুক কিছুটা নিজের মত করে না হয়। আপনি এতদিনের অপাত্রে দান ভুলে শুধু ওর পাশে থাকবেন না হয়! আমার বিশ্বাস ও যখন এতটা পেরেছে বাকিটা ও ঠিক পারবে।

ভদ্রলোকের চোখ দুটো জানি না কোন বিশ্বাসে উজ্জ্বল হল।