প্রবন্ধ

তুমি কৈকেয়ী [পুস্তক আলোচনা] (অষ্টম পর্ব)



কাকলী দেব


।। ৮ ।।

ফিরে এলে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আবার অযোধ্যায়। জয়ের উৎসবে মেতে উঠল গোটা রাজ্য। অনেক দিন পরে প্রাসাদের পাকা রাঁধুনীদের হাতের তৈরী রকমারী খাবার খেয়ে সন্তুষ্টি হল সবার।

এরপর একদিন রাজসভায় রাজা দশরথের নির্দেশে তুমি গিয়ে তার পাশে বসলে। রাজা সমস্ত সভাসদদের সামনে তোমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিভাবে তুমি, তার প্রাণ বাঁচিয়েছ, তার বর্ণনা দিলেন, একমাত্র শম্বাসুরের মৃত্যুর সত্যি কারণটা বাদ দিয়ে। তোমার যদিও বিব্রত বোধ হচ্ছিল। অবশ্য সভার অনেক অমাত্যরা বোধহয় ব্যাপারটা সুনজরে দেখলেন না বলেই তোমার মনে হল!

অন্দর মহলে কৌশল্যার বক্রোক্তি ও সহ্য করতে হল। 'যুদ্ধে যাওয়া বা রাজসভায় রাজার পাশে বসা, কোনওটাই নারীর পক্ষে শোভনীয় নয়, বলেই তার মনে হয়।' কৌশল্যা বলল।

তুমি এসব কিছুতে কান না দেওয়াই শ্রেয় মনে করলে।

রাজা দশরথের তোমাকে বিবাহ করার আসল উদ্দেশ্য ছিল পুত্র লাভ! তোমার ও সন্তান আকাঙ্খা জেগেছে মনে, কিন্ত তুমি চাও তোমার একটি কন্যা সন্তান হোক, যাকে তুমি তোমার মনের মত করে বড় করবে! সে এমন একটা নতুন পৃথিবীর মানুষ হবে, যাকে কোনও পুরুষের ক্ষমতা থাকবেনা, নিজের বাড়ী থেকে বহিষ্কারের! যে পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারে বাঁচবে। পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে তৈরী করবে নতুন পৃথিবী!

কিন্ত রাজার কুল পুরোহিত বশিষ্ঠ, রাজাকে 'পুত্রকামেষ্টি' যজ্ঞ করতে উপদেশ দিলেন। এই যজ্ঞ করার ক্ষমতা ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আছে।

ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি অরণ্যে বাস করেন। তিনি আবার রাজার জামাইও হন সম্পর্কে।

এই ব্যাপারটা তুমি অনেক পরে জেনেছিলে। কৌশল্যা আর দশরথের প্রথমা কন্যা সন্তান ছিল 'শান্তা'। তাকে দত্তক নিয়েছিলেন, রাজার বন্ধু, অঙ্গ দেশের রাজা রোমপাদ। তারপর তার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির। তাই দশরথের অনুরোধে উনি রাজী হলেন যজ্ঞ করতে। শোনা যায়, যদি কোনও রাজ্যে খরা হয়, তখন এই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য। এই মুনিবর জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে এতটাই ক্ষমতাশালী।

ঋষি মুনিরা দলে দলে আসতে লাগলেন, যজ্ঞের জন্য বিশাল আয়োজন শুরু হল।

রাজা তোমাদের তিনজনকে একদিন একসাথে তার বিশ্রাম কক্ষে ডেকে পাঠাল। তুমিও, কৌশল্যা আর সুমিত্রার দেখাদেখি, রাজার পদতলে গিয়ে বসলে। এভাবে আগে কখনও রাজার মুখোমুখি হওনি। দশরথ, তোমাদের যজ্ঞের নিয়ম কানুন বুঝিয়ে বলল!

তোমরা যজ্ঞের দিন, ভোর রাতে উঠে পট্টবস্ত্র ধারণ করে, পূজাস্থলে গিয়ে বসলে। নির্দেশ অনুযায়ী তোমাদের সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে। উপোস করার অভ্যাস তোমার একেবারেই নেই তাই প্রচন্ড খিদের মুখে তোমার গা ঘুলিয়ে উঠছে, তার ওপর যজ্ঞের আগুনের সামনে একভাবে বসে থাকতে গিয়ে মাথা ঘুরছে। সন্ধ্যার সময় যখন যজ্ঞ প্রায় শেষ, তখন যজ্ঞের আগুনের ধোঁয়ায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, একটি অগ্নিমূর্তি যেন কিছু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হল। আচ্ছন্ন অবস্থা তোমাদের তিনজনেরই! রাজার হাতে কেউ যেন কিছু দিল! ঋষ্যশৃঙ্গ আর দশরথ দুজনে এসে তোমাদের বলল, "অগ্নিদেব নিজে এসে একবাটি ক্ষীর দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, এই ক্ষীর তোমরা খেলে, তোমাদের পুত্র সন্তান লাভ হবে।" বড়রাণী বলে দশরথ, ক্ষীরের বাটি কৌশল্যার হাতেই দিল। কৌশল্যা তখন, অর্ধেকটা ক্ষীর খেয়ে, সুমিত্রার হাতে দিল, সুমিত্রা আবার অর্ধেক খেয়ে, তোমার হাতে দিল।

এই ক্ষীর বা পায়েস জিনিসটা তুমি চিরকাল অপছন্দ করেছ, আজও পুরোটা খেতে পারলেনা, আদ্ধেক খেয়ে আবার সুমিত্রার হাতে দিয়ে দিলে, সুমিত্রা তখন, ভগবানের প্রসাদ বলে, ফেলতে না পেরে বাকীটা খেয়ে নিল।

তারপর কোনও রকমে, তোমরা নিজের নিজের মহলে ফিরে গেলে। সারাদিনের ধকলের পরে, একেবারে নিঃসাড়ে ঘুমালে।

এরপরের ঋতুচক্র হল না তোমার, শোনা গেল কৌশল্যা আর সুমিত্রার ও একই অবস্থা হয়েছে। অবশ্যই তোমাদের সবারই খুব আনন্দ হল! একে একে এই সুখবর রাজা থেকে আরম্ভ করে সমস্ত প্রজারই কানে গেল।

তোমার খবরে সবচেয়ে খুশী হল মন্থরা! সে যে কী করবে আর কী না করবে ভেবে পাচ্ছেনা।

এইভাবে মন্থরার পরম যত্নে, রাজা দশরথের তত্বাবধানে নির্বিঘ্নে নবম মাসে তোমার গর্ভ অবস্থা পূর্ণ হল। এই সময়ে তোমাদের তিনজন সতীনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরও গাঢ় হল। একে অন্যের, সুখ দুঃখের অংশীদার হলে।

যথানিয়মে এক শুভদিনে তুমি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলে। তার ঠিক একদিন আগেই কৌশল্যার একটি পুত্র জন্মেছে। ধাই যখন তোমার কোলে দিল তোমার ছেলে কে, তখন মেয়ে না হওয়ার সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলে। ছোট শিশুটির কোমল মুখ খানা চুম্বনে ভরিয়ে দিলে।

এর পনেরো দিন পরে, সুমিত্রার দুটি যমজ ছেলে হল। রাজা দশরথের মনোস্কামনা এতদিনে পূর্ণ হল। চার চারটি পুত্রের জনক হলেন তিনি।

ছোট শিশু, বিশেষ করে ছেলেদের বড় করার অভিজ্ঞতা তোমার আছে । নিজের ছোট ছোট মাতৃহারা ভাইদের বড় করতে তোমারও একটা ভূমিকা ছিল। সুতরাং নিজের ছেলেকে তুমি সম্পূর্ণ নিজে হাতে বড় করতে লাগলে! তাকে দুধ খাওয়ানো, তেল মাখানো, স্নান করানো, ঘুম পাড়ানো, সমস্ত কিছুই নিজে হাতে করতে লাগলে। আর নিজের পছন্দ মত, গোটা ভারতবর্ষের নামে, তার নাম রাখলে, 'ভরত'। এই একটা ব্যাপারে কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করোনি।

কৌশল্যার ছেলের নাম, 'রাম'। আর সুমিত্রার দুই ছেলের নাম, লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন।

(ক্রমশ)

গ্রন্থের নামঃ কৈকেয়ী (Kaikeyi: A Novel)
লেখিকাঃ বৈষ্ণবী প্যাটেল (Vaishnavi Patel)
ভাষাঃ ইংরাজী
প্রকাশকঃ রেডহুক (Redhook)
বাঁধাইঃ পেপারব্যাক
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫১২ পাতা
মুদ্রিত মূল্য (ভারতীয় মুদ্রায়): ১,৭৩৪ টাকা