প্রবন্ধ

শেখর দাশের 'মৃতবৎসা ও অন্যান্যরা' [পুস্তক আলোচনা]



চিরঞ্জীব হালদার


যাওয়া সত্য। পৌঁছানো কেবল অবভাষ। এমন কঠোর বাস্তব মনে রেখে আলোচিত গ্ৰন্থপাঠে এক পরাবাস্তব সমুদ্রে আপনি হাবুডুবু খাবেন। যা অন্য এক সুখানুভূতি। এটা সত্য। এমন সত্যের পুনঃজন্ম হয় কোনও কোনও গ্ৰন্থপাঠে।

সদ্য ডানামেলা অক্ষরযাত্রার প্রকাশনার অসাধারণ গল্পসংকলন এই বছর প্রকাশ পেয়েছে "শেখর দাশের ছোট গল্পে। প্রখমেই 'শেখর দাশ ও তার গল্পবিশ্ব' এই বয়ানে অধ্যাপক তপধীর ভট্টাচার্য্যের আসাধারণ বয়ান এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এটা এই পুস্তকের এক মূল্যবান উপস্থাপনা। পাঠ শেষে আপনি একমত হতে পারেন আবার উল্টোটাও ঘটতে পারে। এই বয়ান এমন এক হৃদ বায়নোকুলার, যা দিয়ে চুলচেরা সংক্ষিপ্ত দেখে নেওয়া যায়, যা পাঠক পড়তে চলেছেন। উচ্ছের মালাইকারি না হিমবন্ত সকালে অতি সাধারণ ঘরণীর হাতে মহার্ঘ দার্জিলিং চা। অধ্যাপক মহাশয় শেখর দাশ সম্পর্কে ও তার মননবিশ্বকে আমাদের সামনে রাখলেন বা জাত চেনালেন তা এই গল্প পাঠের পর কখনো অতিরঞ্জন মনে হয়নি। প্রসঙ্গত যেকোন পাঠ ও তার পরবর্তী আলোচনায় প্রতি আলোচকের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ যে তার ভাববিশ্বকে যথাযথভাবে উত্তর পাঠকের দরবারে কিভাবে তুলে ধরবেন।

এখানে নিজস্ব বোঝার পরিমিতি অনেক সময় মূল্যবান না ঠেকতে পারে, বা যা বোঝা হল তার প্রকৃত অর্থে ঠিক হল কিনা। বা নিজস্ব মূল্যায়ন কতটা সৎ। আসলে সৎ সাহিত্যের এক অভিজাত অভিঘাত থাকে। এই গল্পপাঠে যে পরাবাস্তবতার অলৌকিক সমীহ আমাকে ঘিরে ধরেছে তা বোঝানো এক কথায় মুশকিল। আমার তেমন কৌলিন্য নেই এমন গদ্যের সঠিক মূল্যায়ন। তবু কোথাও এক দায়বদ্ধতা জমে থাকে। কিছুদিন আগে জাকির তালুকদারকে পড়ছিলাম।তারপর এই গ্ৰন্থ সমান টেক্কা দিয়ে গেছে। আল্লারাখার বাদনের পর জাকির হোসেন না শুনলে আপনার দিনটা আর দিন থাকবে না। সারাক্ষন আপনি জারিত হবেন। এই পাঠ এমন এক অনুভব।

তবে আপনার আপ্লুতিগুলো যে সমকম্পাঙ্কে আমার সাথে উড়াল দেবে এমন হয়তো নয়।কিছু দিন আগে গদ্য ও পদ্যের ভেদ রেখা পড়তে গিয়ে সে এক মহাফ্যাসাদ। এবসার্ড গদ্যের মত 'শ্বেতরক্তকণা'য় ড্রাইভার ও তার বুক পকেটে রাখা অক্ষম চিঠিগুলোর মত এক ঠাঠা মাঠ।

যেখানে ড্রাইভারের হ্যালুশিনেসানে ঢুকে পড়ে সারি সারি নেতানো বৈদ্যুতিক খুটির সমাহার। তার শীর্ণ হাতের নির্ধারিত কন্ট্রোল ভেদ করে বেপরোয়া আ্যক্সিলেটার দাবানল এর মত জেগে উঠতে চায়। মাড়িয়ে যেতে চায় ওই খুঁটি গুলোকে। তারপর গাড়ি থেকে গ্যারেজে নামার পর সে অবধারিত যেন ঢিল ভেবে এক অক্ষম আক্রান্তের মত পকেটের সব মরমী বর্ণমালা গুলো ছুঁড়ে দেবে কুকুরের দিকে। পুরাতন গাড়ি, তবে মোটর মেকানিক গাড়িটার খুঁত খুঁজে পাবেননা। শেষ পর্যন্ত শকএবজর্বারকে ভিক্টিমাইজ করাই সাব্যস্ত হবে। অবশেষে..., "বেশ আস্তেই হাঁটতে হাঁটতে বুকের বেমক্কা চুলকানোয় ভুলে গেল স্পীডে মিটারের কয়েলটা ঠিক করার কথা বলা হয়নি। কাঁটাটা ভাঙা ছিল। ইঞ্জিনের বন্ধ করা শব্দের মতো শব্দ করে এগোচ্ছে। নাক কোঁচকানো। নাকটা গাড়ির সাইলেন্সারের মত।..."

এখানে ভাষার রকম ফেরে কথকের অভিমুখ বদলে যেতে পারে। তা ঘটেনি। তবে এ গল্পের মনস্তাত্ত্বিক মেধাবৃত্তি আরও একটু প্রসারণমুখী হওয়া কাঙ্খিত ছিল।

'ডায়নোসরের ফুসফুস' কথনে গদ্য ও পদ্যের ভেদরেখা একে অন্যের মধ্যে শীতের আলোয়ানের মতো। অনুমানমাত্রিক পাঠক কোথায় নিজেকে দাঁড় করাবেন এগল্প পাঠের পর তা তিনি বলতে পারবেন। "ডান হাতের কর্মতৎপর ব্রাস দাঁত ও মাড়ি ঘসে"। কর্মতৎপর শব্দের আসাধারণ ব্যবহারিক নৈপুণ্য এই বাক্যবন্ধে থমকাতে হয়।

যেন নিস্তরঙ্গ অলঙ্কার। যা উত্তর আধুনিক গদ্যে হামেশাই চোখে পড়ে।

'ফেরারী' এক অসাধারণ বাদামী প্রলেপ। সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতায়। স্থির ও একই ভাবে চঞ্চল। প্রশ্ন আর প্রতিপ্রশ্নকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার। এমন সব বাদামী আঁচড় ঝলসানো গদ্য। পাঠক আরও ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে।ভেদরেখা অবলুপ্ত হয়ে সমে ফেরার মত গদ্যের পেলব বাস্তবতায় ফিরে আসে অমোঘ সম্পর্কের হাত ধরে।

আমাদের নৈমিত্তিক সম্পর্কের মধ্যে এক এক সময় হাড়হিম হাহাকার দানাবাঁধে। শেখর দাশের আত্মসংলাপেরা যেভাবে দানাবাঁধে তা গল্পকারের নিজস্ব পরিধি। "তোমরা যদি রাঁচি যাও সেখানকার আকাশ-বাতাস কে বলে দিও, আমি ভালো আছি। কিন্তু মোরাবাদী মাঠের স্বপ্নের ঘুম যেন ভুলেও ভেঙে দিও না। এক ঝিমধরা প্রশ্ন সবার পৃথিবীতে জেগে থাকে, 'কিন্তু নীলুদি কে হয়।' " এখন থেকে পাঠ করতে করতে পাঠক এখানে পৌঁছবেন - "কোথায় থাকে সেই নারী। এরকম নারীদের কোন নিবাস নেই।" এই অনুসন্ধান করতে করতে কারো কারো যৌবন পার, স্বপ্ন পার। তারই এক স্বগত কথন যেন 'ফেরারী' গল্পে জেগে থাকে। পাঠককে আরও এক প্রশ্নের কাছে দাঁড় করিয়ে দেন শেখর দাস - "তোমার চোখে নীল জল দেখে অনেক জাহাজ ভুল পথে বন্দর ছেড়ে যায়।"

আমাদের প্রতি সম্পর্কের ভেতর এক তারল্য ও ঘনত্ব পাশাপাশি বিদ্যমান। এনার গল্পে প্রতি স্তরে নবনব রূপে ঘনীভূত হয় আমাদের চেতনায় ও একই সঙ্গে চেতনাতীত স্তর।

আবছায়া সাম্প্রদায়িক আবহ ভরপুর 'আজান'।

সমরেশ বসুর 'আদাব' গল্পটা মনে পড়ছিল। বেঁচে থাকার পিছল ত্রিকোনোমেত্রিতে বারবার জীবন এক নাছোড় খাদের পাশে দাঁড় করায়। ঠুনকো জগতের এক দ্বন্দ্ব বিধুরতা কঠিন ও জটিল পরিস্হিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। এখানে কোন সম্প্রদায় নয়। ব্যক্তিগত আক্রোশ কখন কোন মুখোশ পড়ে ফেলে বোঝা মুশকিল।

আলী সাহেবের মতন লোকেরা অপরাধ না করেও কঠোর অপরাধের তকমা লেগে যায়। যা অস্থির আবহে কোন বৃহত্তর গোষ্ঠীর আড়ালে এক ভংয়কর অসুখ সমাজকে কচু কাটা করে বিপুল ঘূর্ণিতে ভাসিয়ে মারে। সম্প্রদায়কে সামনে রেখে ব্যক্তি ইচ্ছের লোলুপ পরাক্রম চূড়ান্ত সংবেদনময় এই গল্পের আধার।

- "আমরা যা যাচ্ছি সেখানেও কি এখানকার মতো খেলনাপুর আছে"

সব শিশুর ভেতর এক রাইকোমলের বাস। তার জিজ্ঞাসাগুলো যেকোন সংবেদনী অভিভাবকে এক অপূরণীয় ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ঠেলে দিয়ে নিরুদ্দেশ।

এই অভাব ও শিশুমনের আর্তি এই সংকলনের প্রথম গল্প 'জনসভা'। এক বড় বিহ্বলতার ভেতর পাঠকে ছেড়ে দেন গল্পকার - "এই শিশুটির কথা ভাবুন তো একবার। উৎখাতে এর জন্ম।আপনাদের কাগজের ভাষায় ভবিষ্যতের শিশুটি আতঙ্কবাজ হলে দোষের কিছু আছে।

দারুন কাটা কাটা চরিত্রচিত্রনে "মৃতবৎসা" গল্পে জগার মার অসাধারণ দম।

- তোমার ছেলে? জগা?

- নেই।

- তোমার স্বামী?

- আসাম গেছে।

- আসেনা?

- না বোধহয় আসবে না।

- খবর পেয়েছ?

- গনকঠাকুর বলে, মরে গেছে। দাঙ্গায়"।

এত স্মার্ট ও স্বচ্ছ কথোপকথন গল্পকার তুলেছেন এখানে শেয়ার না করার লোভ সামলানো গেল না।

- বাড়ির কথা মনে হচ্ছে?

- না।

- তো কি দেখছো।

- লুক্কা। ওই যে!

- ওরা তো তোমাদের ওদিককার লোক।

- হ্যাঁ। আচ্ছাদিদি, আপনি ভোট দেন?

- ভোট!

- হ্যাঁ কাকে দেন?

- সময়মত যারা বেশী ফুসলাতে পারে (যদিও এটা গল্পকারের যুগ্ম সংলাপ)

- তখন থেকে কেবল হাসছো? কি ব্যপার?

- আপনার বড় দয়া গো দিদি।

- হাসি পেল বুঝি।

- পায় দয়া দেখলে হাসি পায়।...

মুখে হাসি নেই এখন। মাথা একটু উঁচু করে দেওয়ালের দিকে তাকাল। সকালের সেই ঘোলাটে দৃষ্টি। জেদ ও অন্যমনস্কতা। বলার পিছনে অহেতুক আবেগ নেই।তোয়াজ নেই। স্বরে আর্দ্রতা নেই। সততা আছে।...

এই অস্তিত্ব হারানো মানুষের চরিত্রচিত্রন যেন এক বেদরদী কাঠের গুড়িকে বাঁটালি দিয়ে বিন্দু বিন্দু গড়ে দিয়েছেন গল্পকার। কারো সাথে তুলনায় যাচ্ছিনা। তবু যেন 'স্তনদায়িনী'র কথা মনে করায়। যদিও সে এক অন্য প্রেক্ষাপটে গড়া।

মোট ১৯টি গল্প এই পুস্তকে সংকলিত। হয়তো 'অক্ষরযাত্রা' প্রকাশনী এটাকে প্রকাশ না করলে একজন শক্তিশালী গদ্যকারের সাথে মোলাকাত হতো না। আমাদের জীবন সীমিত। পাঠ ও সীমিত। ইচ্ছের কথা নাইবা বললাম।

এই গল্পপাঠ আমার কাছে সমাপতন। এই বাংলায় ক্রমশঃ কবিতার মত দৃঢ় গদ্যের নির্মাণ সতত ঘটে চলেছে। সব সময় সব পড়া হয়ে ওঠেনা। অবশ্য খুব শক্তিশালী গদ্যকারের নিভৃতির জায়গা ভেদ করে সাধারণ পাঠকের দরবারে পৌঁছতে অনেক সময় লাগে। বাজার চলতি পত্র-পত্রিকার বাইরে অনেকেই থেকে যাচ্ছেন আমরা জানিনা।

শেখরবাবুও হয়তো এদের একজন। গত বছর জাকির তালুকদার পড়েছি। তার রেশ এখনো আছে। এখানে মৃতবৎসার মত গল্প অনেককাল মগজ অধিকৃত থাকবে। শেখর দাশের নিভৃতিময় কৃচ্ছ্রময়তাকে স্যালুট। আর ধন্যবাদ এই বইয়ের প্রকাশক আনন্দ গোপালকে।

তপোধীর ভট্টাচার্য্যরা না থাকলে আমাদের মত সাধারণ পাঠক এর নাগাল পেত কিনা মুশকিল।... "আত্মসর্বস্ব নার্সিসাস হতে চায় না শেখর।সে ঢুকে যেতে চায় সময় ও সামাজিক পরিসরের মর্মে। সম্ভবত সে বিশ্বাস করে, এখনো আমাদের কাছে আসল বাস্তব ধরা দেয়নি। মুখোশের শিল্প বিভ্রান্ত করে কেবলই। ওই বিভ্রান্তি থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে চায় শেখরের ছোট গল্প।"