বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (ষোড়শ পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]

।। ১৬ ।।

প্রাণতোষ রওনা দেবার তোড়জোড় করতেই আগে নজরুল বলে উঠলেন, 'চল্, তোর সঙ্গে আমিও যাব। অনেকদিন কলকাতা যাওয়া হয়নি'।

শরীরের ঝামেলা তো বটেই, সকালে ভালো তো বিকেলে জ্বর চলে আসে। তবে কৃষ্ণনগরে আসা থেকে এই অল্প কদিনেই নজরুলের অনেকটা উন্নতি হয়েছে। নগেন ডাক্তারের ওষুধে প্রাণ আছে। আগের মতো এই বেলা ওই বেলা জ্বর আর আসে না, অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাছাড়া জ্বর বাবাজি আর সেরকম ঝড়ের বেগে এসে হাড় কাঁপুনি দেওয়া শুরু করে না। তার উপরে আছে পরিবারের শাসন। হুগলিতে হামিদ মোক্তারের বাড়িতে শাসন বলতে ছিল মাসিমার কড়া নির্দেশ আর হাবুল-শচীনদের ঘিরে থাকা পাহারা। সেখানে দোলনের আলাদা করে কোনও উপস্থিতি টের পাওয়া যেতো না। কৃষ্ণনগরে গোলাপট্টির গলির ভিতরে দোলন যেন হঠাৎ করে প্রমীলার চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। নগেন ডাক্তারের ওষুধ, দোলনের স্নেহশাসন আর হেমন্তদার অভিভাবকীয় নির্দেশিকা - সব মিলিয়ে শরীর ও মন দুটোই যেন খোলস ছেড়ে উঠছে। আর এক বেলা শরীর ভালো হলেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

- আজকেই যাবে?

আচমকা যেন একটা ধাক্কা খেল প্রমীলা? নানান বিপদ কাটিয়ে ক্রমশ সেরে উঠছে মানুষটা। বিয়ের পর প্রায় দুই বছর পার করে সদ্য কিছুটা কাছাকাছি পেতে শুরু করেছে তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রিয় পুরুষটিকে। নজরুলের চঞ্চল বিবাগী প্রকৃতিকে সে বিলক্ষণ চেনে। ঘরে আটকে থাকার মানুষ তিনি নন। তাঁর নিজের সে ক্ষমতাও নেই হয়তো। সেই কারণেই একটা অজানা আশঙ্কা বুকের মধ্যে এসে গোপনে কাঁপুনি দিয়ে গেল।

- কতদিন কলকাতা যাইনি বলো। ওদিকে মণিদার ঘাড়ে লাঙল চাপিয়ে চলে এসেছি। একা মানুষটা হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এসেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার দেখো আমি হুগলি ছেড়ে কৃষ্ণনগর এলাম, ওদিকে মুজফ্‌ফর সাহেব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা এলেন - তাঁর সাথে দেখাই হলো না।

দোলন সবই বোঝে। কাহিল শরীর আর জ্বরের ঘোর নিয়েও হুগলিতে 'লাঙল' নিয়ে নজরুলের কী উত্তেজনা! পার্টির ইস্তেহার লিখছে, কবিতার পর কবিতা লিখে চলেছে। শ্রমিক, কৃষক, নীচুজাতি, নারী জাতি সবার সম্মানকে তুলে ধরার কথা লিখছে। পতিতা নারীদের নিয়ে লেখা কবিতাটি পড়ে গর্বে আর ভালো লাগায় দোলনের চোখে জলের ধারা নেমেছিল। 'লাঙল'এর মধ্যে তাঁর প্রাণভোমরা ঢুকে আছে। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ নজরুলের মনে কতখানি জুড়ে আছেন সেটাও দোলন বোঝে। সেই কান্দিরপাড়ে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল। কলকাতা থেকে কুমিল্লায় এসেছিলেন নজরুলকে নিয়ে যাবার জন্য। মনে আছে, সেদিন ছিল রথের মেলা। সারাদিন নুরুদা আর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে শহর ঘুরেছিল ওরা। কী আনন্দই না হয়েছিল সেদিন! আনন্দ বললে কিছুই বলা হয়না। সে এক অদ্ভুত শিহরণ, বাতাসে রঙিন প্রজাপতি উড়তে দেখা শুরু হওয়া সদ্য কিশোরীর এলোমেলো করে দেওয়া বিকেল। রাস্তায় ভিড় আর লোকজনের ভেতর দিয়ে গাড়ি যতবার দোল খায় ততবার নুরুদার শরীরে ছোঁয়া লাগে। প্রতিটি স্পর্শের সঙ্গে সারা শরীরে অদ্ভুত এক ভালোলাগার বিদ্যুত খেলে যায়। সেদিনের ১৩ বছরের কিশোরী বুঝতে পারেনি, কিন্তু আজ দোলন বুঝতে পারে - সেই শিহরণই তার কাল হয়েছিল। প্রতিটি স্পর্শে ভালো লাগার অন্যরকম আকর্ষণ তাকে নুরুদার দিকে এক অপ্রতিরোধ্য চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সে কথা মনে পড়লে আজও শরীরে শিহরণ খেলে যায়। সঙ্গে জটু, কমলা ছিল। আর ছিল ছোট্ট ভাইপো রাখাল। সারা পথে তার দুষ্টুমি আর লাফালাফি। খেলনা, রথ কিংবা জিলিপি, পাঁপড় কিছুই তাকে আকৃষ্ট করে না। তার সমস্ত আকর্ষণ চলমান ঘোড়াটির দিকে। যতবার সে পালক সাজানো মাথা ঝাঁকুনি দেয়, অমনি কেশরে গাঁথা ঝুমঝুমি বেজে ওঠে - আর কোলের কাছে জাপটে ধরে রাখা রাখাল আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।তাকে ধরে রাখতে গিয়ে দোলনের শরীর নুরুদার শরীরে বারবার ধাক্কা খায়। খানিকটা হয়ত ইচ্ছে করেই রাখালকে খেপায়। তাতে নুরুদার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তো মুজফ্‌ফর সাহেবের সাথে কীসব ভারি ভারি কথার গল্পে মশগুল। কান্দিরপাড়ের কত মানুষ যে নুরুদাকে চেনে!কাজীদা, বলে প্রায়ই কেউ না কেউ এসে কথা বলে যাচ্ছে। বিখ্যাত একটা মানুষকে পাশে নিয়ে শহরে ঘুরছে - সেটাও একটা বাড়তি ভালো লাগার রেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ফিরেও সে রেশ কাটেনি। সন্ধ্যেবেলায় গানের আসর বসেছিল। নুরুদার কথায় দোলন আর কমলা দুজনেই গান গেয়েছিল, তাঁরই শেখানো গান। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ একটু রাশভারি, কম কথার মানুষ। কিন্তু গানের আসরে বসে মাথা দুলিয়ে মন দিয়ে গান শুনেছেন।

নুরুদা কি সেদিন বুঝতে পেরেছিল তার এই ভালো লাগার কথা? আকর্ষণের কথা? সে তো কবি মানুষ। কবিরা সব বুঝতে পারে, নইলে ওরকম করে কবিতা লিখল কেন - 'হে মোর রাণি, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে'? তার হাতেই বা গোপনে আলাদা করে দিতে গেল কেন? কি জানি, দোলনের কাছে ঠিক পরিষ্কার হয় না। শুধু মনে হতো এক বিশাল সিংহ ছোটো মোলায়েম বিড়ালের মতো তার কোলের কাছে এসে আদর পেতে চাইছে। বড়ো আপন, বড়ো নিজের।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শেষমেষ স্বামী হিসেবে পাওয়া সেই মানুষটি কি আজও বুঝতে পারে - কাছে পাওয়ার কী তীব্র আকর্ষণ তাকে টেনে ধরে থাকে? জানে না। দোলন বুঝতে পারে না সে মানুষটার মনের মধ্যে কখন কিসের ভাব খেলা করে বেড়ায়। সে জগত তার একপ্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে, তার চেষ্টাও সে করে না। শুধু চায় - মানুষটা তার কাছে থাকুক, কাছাকাছি থাকুক। বেশি দূরে কোথাও নয়, সামান্য কলকাতায় যাওয়ার কথাটা শুনেই তার বুকের ভিতরটা যেন কেঁপে উঠল। একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস - নজরুল কিংবা প্রাণতোষ - কারো চোখে পড়ল না।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ কোনদিনই উচ্ছ্বসিত হবার মতো প্রকৃতির মানুষ নন। তবু ৩৭ নম্বর হ্যারিসন রোডের দোতালায় সিঁড়ির মুখে নজরুলকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। 'কাজী সাহেব, আসুন আসুন! কতদিন পর দেখা!'

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের চোখে এই প্রথম নজরুল একটা আড্ডা দেবার বন্ধুর মতো উচ্ছ্বাস দেখলেন। সেই করাচি থেকে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে প্রথম যেদিন পা রেখেছিলেন, সেদিন থেকে বরাবর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ নজরুলকে আগলে রেখেছেন - একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী অভিভাবকের মতো। যখনই সংকটের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন আর কেউ না হোক মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। দৌলতপুরে বিবাহ বাসরের গোলযোগ, তারপরে কান্দিরপাড়ে দীর্ঘ সময় যাপন - একদিকে একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অপরাধ বোধ, তার পাশাপাশি সেনগুপ্ত পরিবারের সাথে ক্রমবর্ধমান স্নেহসম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়া - সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মানসিক অসহায়তা এসে ঘিরে ধরেছিল। অনেক বন্ধুজনের সাথেই চিঠি চালাচালি হয়েছিল, কিন্তু কলকাতা থেকে কুমিল্লায় গিয়ে নজরুলকে প্রায় উদ্ধার করে এনেছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। এর আগে দেওঘরে গিয়ে যখন কপর্দকশূন্য অসহায় অবস্থা ঘটে, তখনও সেই মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ছিলেন ত্রাণকর্তা। তালতলার ভাড়াবাড়িতে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গ ছেড়ে আফজালুল হকের আশ্রয়ে যাওয়াটা যে কতটা ভুল হয়েছিল, সেটা নজরুল এখন উপলব্ধি করেন। একটা অভিমান অবশ্য সেদিন বুকে বেজেছিল। সারারাত জেগে বিপুল উত্তেজনায় ভর করে 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখছেন। নিজের ভিতরেই টের পাচ্ছিলেন যে এক যুগান্তকারী কবিতা আজ তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি হতে চলেছে। পাশের তক্তপোষে ঘুমিয়ে আছেন মুজফ্‌ফর সাহেব। জেগে উঠলেই তাঁকে শোনাতে হবে। তখন তাঁর কী অভিব্যক্তি হতে পারে সেই কল্পনাও ভিতরে একটা উত্তেজনা ক্রিয়া করে চলেছে। ভোরবেলা তিনি জেগে ওঠার পর বিপুল আগ্রহ নিয়ে আবৃত্তি করে শোনালেন সেই বীরত্ব ব্যঞ্জনাময় কবিতা। কিন্তু মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের চোখেমুখে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। উচ্ছ্বাস প্রকাশ তো দূরের কথা, ভালোমন্দ কিছুই তিনি বললেন না। সারারাতের উত্তেজনা কোথায় যেন এসে একটা ধাক্কা খেয়ে গেল। নজরুল জানেন তাঁর গম্ভীর প্রকৃতির কথা, তবু অন্তরে তো তিনি সাহিত্যের যথেষ্ট উচ্চমানের বোদ্ধা, প্রকৃত সমঝদার। তাঁর হাত ধরেই তো করাচির হাবিলদারি থেকে কলকাতার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। একটা অভিমানের তীর হালকা হয়ে বুকে বিঁধেছিল। আজ তার চোখেমুখের উচ্ছ্বাস নজরুলকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

আক্ষরিক অর্থেই হ্যারিসন রোডের দোতলায় 'লাঙল' পত্রিকার অফিসটা যেন ভেসে যেতে থাকল। কে বলবে ম্যালেরিয়ায় প্রকোপে তাঁর শরীর কাহিল। সেই সকালে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে শিয়ালদায় নেমেছেন। সবচেয়ে খুশি মণিদা - মণিভূষণ ভট্টাচার্য। 'কাজী ভায়া, আমার কাঁধে জোঁয়াল চাপিয়ে তুমি কৃষ্ণনগর চলে গেলে। এখন এ লাঙল টানবে কে? এসব কি আমার কাজ?'

নজরুলের সহাস্য উত্তর - 'মণিদা, লাঙল টানার বলদ তুমি ঠিক পেয়ে যাবে, ও তোমাকে নিজে টানতে হবে না। কিন্তু বলদ হাঁকানোর উপযুক্ত লোক তো চাই? সে কাজে তুমি ছাড়া আর আছে কে? করাচির ক্যান্টনমেন্টে তোমাকে অতগুলো বলদের খাবার-দাবার, জামাকাপড় গুলি-বন্দুক সব একা হাতে সামাল দিতে দেখেছি। এটা তো তোমারই কাজ!'

- সে যাই বলো বাপু, লাঙল তো তোমার নামেই বিকোচ্ছে। 'সাম্যবাদী' ছিল বলেই প্রথম সংখ্যার ৫ হাজার কপি হুড়মুড় করে বিক্রি হয়ে গেল। কলেজ স্ট্রিট তো আছেই, শিয়ালদা হাতিবাগান ধর্মতলা সব জায়গা থেকে হকারেরা দুবার করে এসে পত্রিকা নিয়ে গেছে। বাংলা পত্রিকার ইতিহাসে প্রথম সংখ্যাতেই এরকম ঘটনা কোনোদিন ঘটেছে? কিন্তু তারপর - সেই চাহিদা তো ধরে রাখতে হবে?

ঘরে তৃতীয় একজন উপস্থিত আছেন। ঢুকেই দেখা হয়েছে - সৌম্যকান্তি, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন বসে আছেন। কিন্তু স্রোতের মতো কথার তোড়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করার সময় হয়ে ওঠেনি। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ হয়তো এই উচ্ছ্বাসকে সাময়িক আটকাতেই তড়িঘড়ি পরিচয় করিয়ে দিলেন - ইনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির সদস্য। আজকেই আলাপ। আপনি আসবার ঘন্টাখানেক আগে নিজে থেকেই উনি এসেছেন।

ভদ্রলোক সহাস্যে বললেন - 'পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি বাড়িটার উপরে আস্ত একটা লাঙল ঝুলছে। খোদ কলকাতা শহরের বুকে, যেখানে এক ফোঁটা চাষ করবার জমি নেই - সেখানে একটা আস্ত লাঙল! খুব কৌতূহল হল। থাকতে না পেরে ঢুকেই পড়লাম'।

রবীন্দ্রনাথ সর্বজনপ্রিয় নোবেল বিজয়ী এক বিখ্যাত কবি শুধু নন, দরিদ্র প্রজাসাধারণের জন্য জনহিতকর কার্যে তাঁর উদ্যোগ, তাঁর কাজকর্ম সর্বজনবিদিত। কুষ্টিয়া আর শান্তিনিকেতনে কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য কত কী করে চলেছেন। তবুও আভিজাত্য, জমিদারি, বনেদিয়ানা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রগতিশীলতার পাশাপাশি ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা - সব মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির পরিবারকে মানুষ একটা সম্ভ্রমমিশ্রিত দূরত্বের চোখে দেখে। সেই পরিবারে আপাদমস্ত কমিউনিস্ট মানসিকতার একজন মানুষের দেখা পাওয়া সেদিন সবাইকেই বিস্মিত করেছিল। যে কমিউনিস্ট ভাবধারা নজরুলকে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কাছে এনে পৌঁছে দিয়েছিল, সৌমেন ঠাকুরও সেই একই ভাবের পথিক। সুতরাং নিকটজন হয়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। ঠাকুরবাড়ির লোক - সুতরাং গান তো হবেই। দু'জনেরই গান হলো, হইচই হলো, কথাবার্তা হলো। তর্ক-বিতর্ক হলো। বিকেলের দিকে হেমন্ত সরকার এলেন। নানারকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে। একদিনের পরিচয় হলেও সৌমেন্দ্রনাথ এই সিরিয়াস আলোচনার সঙ্গী হয়ে গেলেন। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ জানালেন - এম এন রায়ের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। লোক মারফত কথাবার্তা হয়েছে। লেবার স্বরাজ পার্টিকে যেভাবেই হোক আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার ভাবধারার সঙ্গে একটা জায়গায় বোধ হয় আমাদের একটা গরমিল থেকে যাচ্ছে - এদেশ কৃষকের দেশ, এখানে শ্রমিক বলে একটা শ্রেণিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা খুব মুশকিল।

একথায় দ্বিমতের কোনো অবকাশই নেই। হেমন্ত সরকার বললেন, 'পার্টি শুধু শ্রমিক-কেন্দ্রিক হলে বিশাল বঙ্গদেশে সাধারণ কৃষক প্রজাসাধারণের কাছে তার ভাবমূর্তি খুব একটা আপন বলে মনে হবে না। সুতরাং শ্রমিকের সাথে কৃষককেও জুড়ে নিতে হবে। এই মুহূর্তে সুভাষের বড়ই অভাব বোধ হচ্ছে। সে থাকলে এতোদিনে লেবার স্বরাজ পার্টিকে অনেকটাই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারতো। তেমনি দেশবন্ধুর অভাবে নেতাদের এইসব পাঁচ রকম টানাটানিও অনেক কম হতো। নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির জেলা সম্মেলন গুলিতে আমাদের বেশি করে যুক্ত থাকতে হবে। দলের সাম্যবাদী ভাবধারার কথা প্রচারের সুযোগ নিতে হবে।

- তাহলে সম্মেলন ডেকে নামের সঙ্গে কৃষককে জুড়ে দেবার প্রস্তাব পাশ করানো হোক। তাছাড়া জাতীয় কংগ্রেসের আরো বিশটা ছায়া সংগঠনের ভিড়ে না থেকে প্রলেতারিয়ার মূল ভাবনাটা সামনে রেখে দলকে মুক্ত ও স্বাধীন ঘোষণা করে দেওয়া হোক। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ উল্লেখ করলেন।

স্থির হলো ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কৃষ্ণনগরে প্রজা সম্মেলন হবার কথা, সেখানেই এ নিয়ে কথা হবে, প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। আর সুভাষের মতো একজন শক্তিশালী নেতা দীর্ঘসময় সেই মান্দালয় জেলে আটকে রেখে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। সামনে ওর জন্মদিন। সেই উপলক্ষে লাঙলে একটা বিশেষ সংখ্যা বার করতে হবে। মুজফ্‌ফর সাহেব কী বলেন? কাজী, মণিদা তোমরা দ্যাখো কী করা যায়।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সম্মতি জানিয়ে বললেন, 'উত্তম প্রস্তাব। তবে এবার থেকে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমাদের সঙ্গে থাকছেন'।

সৌমেন্দ্রনাথ খুশি হয়ে বললেন, 'অবশ্যই!'

(ক্রমশ)