বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (ত্রয়োদশ পর্ব)



মমতা বিশ্বাস


জ্যৈষ্ঠের শেষ। তাপমাত্রা ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। চোখ রঙিয়ে সূর্যি ঠাকুরের আবির্ভাব ঘটে। সকাল নটা থেকেই রাস্তাঘাট শুনসান। চাষিরা কড়া রোদের তাতে মাঠে তিষ্টতে পারে না। ফুটিফাটা মাঠঘাট। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। খেতেই - ফসল ও সবজি পুড়ে যাচ্ছে। করোনার পর থেকে অধিকাংশ কৃষকরা হীনবল হয়ে পড়েছে। কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না। তারপর এই তীব্র তাপপ্রবাহ। ঘরে ঘরে অজানা জ্বর, পাতলা পায়খানা হচ্ছে আগছার। বয়ষ্ক ও ছোটোরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বড়ো মণ্ডলের ছয় বছরের ফুটফুটে নাতিটা দুইদিনের জ্বর-পায়খানায় মারা গেল। শোকে বউটা উন্মাদ। অসহ্য গরমে মানুষের চোখে ঘুম নেই। দিনের পর দিন এভাবে চলে না। সামর্থ্য যার আছে; সে এসি কিনছে। সম্পাদ মাস্টার চিন্তিত হয়ে পড়ে। এতে পরিবেশের আরও ক্ষতি হবে। চৌমাথায় বসে পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করে। তাপপ্রবাহের কারণ বিশ্লেষণ করে। বলে, "আমাদের এইভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ পরিবেশে রেখে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তমানে প্রজন্মের। মানুষ অরণ্য ধ্বংস করেছে নির্বিচারে; প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগিয়ে প্রকৃতির সেই ক্ষত সারিয়ে তুলতে হবে। গরমের হাত থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য এ সি শেষ কথা নয়। বিদ্যুৎ অপর্যাপ্ত সরবরাহে ফ্যান ঘোরে টিকিস টিকিস করে। এইভাবে চলতে থাকলে তাও ঘুরবে না। তখন মানুষ কী করবে?"

এসব কথা বাইরের অনেকে সমর্থন ক'রে; মেনে চলে কিন্তু নিজের বাড়ির অন্যদের এসব কথা বলা মানে অশান্তিকে ডেকে আনা সম্পদ মাস্টারের ছোটো ভায়ের বউটা বড্ড আতুসি। গরম সে মোটে সহ্য করতে পারে না। ওয়াশরুমে পর্যন্ত ফ্যান। এসি চালানো থাকলেও মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘোরে। পায়ের দিকে স্ট্যান্ড ফ্যান ঘোরে। সম্পদ মাস্টারের মা'কে কাঠ ঠেলে দু'বেলা রান্না করতে হয়। এত কষ্ট ক'রে ছোটো বউমাকে ধ'রে রাখার জন্য। বড়োছেলেটার জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। অফিস, সংগঠন নিয়ে মেতে থাকে। শখ - ছবি তোলা, ছিপ দিয়ে মাছ ধরা! ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলে হাঁফিয়ে উঠলেই বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ে - জঙ্গলে। হিমালয়ের বেশ কয়েকটি শৃঙ্গে আরোহণ করেছে।

ইদানিং সে সংগঠন নিয়ে মেতে উঠেছে। 'নদী বাঁচাও' বিভিন্ন সংগঠনের মিটিং-এর জন্য সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়েছে। উদ্দেশ্য প্রশাসনকে জোর ধাক্কা দেওয়া। মাইক নিয়ে চূর্ণী, কলিঙ্গ, ঝোর-পলদাও তীরবর্তী তচল্লিশটি গ্রামে মাইকে প্রচার করেছে। একমাত্র জনরোষ পারে দূর্নীতির জগদ্দল পাথরকে সরাতে। মিটিং-এর দিনে ৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে কাঠ ফাটা রোদে দলে দলে নারী-পুরুষের দল শ্লোগান দিতে দিতে এসে উপস্থিত হয়েছিল বটতলায়। লোকে লোকারণ্য।

'শাসক তুমি সাবধান, দুর্নীতি আর নয়'। ধর্মের ভেক নয়; কর্মসংস্থান আগে চাই। ভিক্ষে নিতে চাই না আর; ন্যায্য অধিকার সবার চাই। শাসক তোমাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলতে চাইলেও; আমরা তোমাদের ভুলতে দেব না' - শ্লোগান লেখা প্লাকার্ড নারী-পুরুষের হাতে।

চৌমাথায় থিকথিকে ভিড়। বটের ছায়ায় মঞ্চ বাঁধা। মঞ্চে বসে আছেন বিভিন্ন সংগঠনের সম্পাদক ও সভাপতিগণ। সবাই মুখিয়ে আছে সম্পদ মাস্টারের বক্তৃতা শোনার জন্য। সম্পাদমাস্টার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সমবেত জনতাকে, 'সাথী বন্ধুগণ' বলে বক্তৃতা শুরু করতে করতালিতে ফেটে পড়েছিল সভা। সেদিনের লোক সমাবেশ প্রশাসনকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। স্থানীয় বিধায়কের গাড়ি মাঝপথে উল্টো দিকে চালনা করে দেয় থানার বড়োবাবু। ক্ষুব্ধ জনতাকে কন্ট্রোল করতে পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চার্জ ক'রে। নারী বাহিনী রেহায় পায়নি। মণি কুমার গুরুতর ভাবে আহত হয়। মাথা ফেঁটে চৌ৺চির। ছত্রভঙ্গ জনতা জান বাঁচানোর জন্য সভা ছেড়ে পালায়। সম্পদ মাস্টারকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে। মণিকুমারের মতো আরও অনেকে লাঠির আঘাতে জখম হয়ে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়। সপ্তাহ খানেক ধরে মণি কুমারের জ্বর ১০৪ ডিগ্রীর নীচে নামেনি; সেই সঙ্গে পাতলা পায়খানা। ফুলটুসি হাসপাতাল চত্ত্বর আকঁড়ে পড়েছিল; কিন্তু ফুলটুসি সুস্থ ক'রে মণিকুমারকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। যেদিন সন্ধ্যের পর মণিকুমারের অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠেছিল, অনুনয়-বিনয় করেও তাকে স্বামীর পাশে থাকার অনুমতি পেল না। জ্বরের ঘোরে 'টুসি, টুসি' করতে থাকে। কাছে ছিল কালা। কালা বাইরে এসে ফুলটুসিকে জানায় সে কথা। ফুলটুসি ছুটে গিয়েছিল গেটম্যানদের কাছে, 'আমারে একটু রুগীর কাছে যেতে দেন। নিষ্ফল মাথা কোটা। রাত দশটা নাগাদ মণিকুমার পাড়ি জমায় পরলোকে।

শেষ সময়ে মণিকুমারের পাশে থাকতে না পারার বেদনায় ফুলটুসি বোবা হয়ে গেছে। কাঁদে না, হাসে না, কথা বলে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বিলের ধারে বসে থাকে। শূন্যদৃষ্টি! কাঁদানো চেষ্টা করে পাড়া-প্রতিবেশী।

"ও রাঙাবউ তোর চোখের জল কী শুকিয়ে গেল; কান বউ; কান। মনের ভাব বের কর। একজন তো চলে গেল, তোর তো বাঁচতি হবে। মেয়ে মানুষ হয়ে ওই লড়াই - আন্দোলন করা ভালো না। সে কতা তো কুনু দিন শুনলিনে। কতা শুনলি, এরাম করে মণি কুমাররে হারাতিসনে।" - কথাগুলো বলে কালার মা কেঁদে ভাসিয়ে দিল।

বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভিন রাজ্য থেকে মেয়েরা ছুটে এসেছিল। কাজকর্ম বেরিয়ে যাবার পর মেয়েরা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফুলটুসির এক কথা - না; সে যাবে না। এই দামোদরের বিল ছেড়ে কোথাও যাবে না।

(চলবে)