কর্ণ ও কুন্তী। শিল্পীঃ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মহাভারতে প্রধান নারী চরিত্র পাঁচটি। এঁরা সকলেই জননী। রাজ অন্তঃপুরবাসিনী। প্রত্যেকেই নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। গঙ্গা সর্বপ্রাচীনা। তিনি দেবব্রত জননী এবং শান্তনু পত্নী। তিনি স্বাভিমানী। নিজ পুত্র দেবব্রতকে তিনি হস্তিনাপুরের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যথাযোগ্য শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। এরপর সত্যবতী। তিনি ধীবরকন্যা। পরাশর মুনির প্রসাদে পদ্মগন্ধা এবং শান্তনুর দ্বিতীয় মহিষী। তিনিও জননী এবং রাজমাতা। অতঃপর গান্ধারী। তিনি রাজরাণী ও রাজমাতা। শতপুত্র ও একটি কন্যা দুঃশলার জননী। গান্ধারী-যাতা হলেন কুন্তী। যাতা শব্দের চলিত অর্থ হল স্বামীর ভায়ের বউ। অর্থাৎ কুন্তী পাণ্ডুপত্নী। তিনি রাজকন্যা ও জননী। এঁদের পরের প্রজন্মের প্রধানা নারী হলেন দ্রৌপদী। তিনি পাণ্ডববধূ। পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী এবং পাঁচপুত্রের জননী।এবার কুন্তীর কথায় আসা যাক। কুন্তী হলেন যদুবংশীয় রাজা শূরের কন্যা এবং শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবের ভগিনী। এঁর প্রকৃত নাম পৃথা। রাজা শূর তাঁর পিতৃষ্বসা, অর্থাৎ পিসির ছেলে, নিঃসন্তান কুন্তীভোজকে, নিজের মেয়ে পৃথাকে দান করেন। তখন থেকে পালক পিতার নাম অনুসারে পৃথার নাম হয় কুন্তী। ফলে কুন্তী তাঁর আসল যে পিতৃগৃহ সেখানে বড়ো হননি। অন্য এক আরোপিত পরিচয় নিয়ে তিনি শিশুকাল থেকে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠে ছিলেন।
মহর্ষি ব্যাসদেব কখনই তাঁর লেখনীতে মানসিক জগত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন নি। তিনি খুব নির্লিপ্ত ভাবে ঘটনা পরম্পরা বিবৃত করে গিয়েছেন। কাজেই পিতৃগৃহ সম্পর্কে কুন্তীর মানসিক অবস্থান তিনি ব্যাখ্যা করেন নি। তবে কুন্তীভোজের গৃহে কুন্তী উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন, একথা জানতে পারা যায়।এই সময়ে যখন কুন্তী নিতান্তই কিশোরী সেই সময়ে এক বিচিত্র ঘটনা ঘটে। সব কিছুই সম্ভবত দৈব নির্ধারিত। তা না হলে মহাভারতের মতো জটিল উপাখ্যান তৈরি হবে কি করে। একদিন মহর্ষি দুর্বাসা অতিথি রূপে উপস্থিত হলেন রাজা কুন্তীভোজের রাজ্যে। দুর্বাসা অতি উগ্র স্বভাবের এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করা দুরূহ ব্যাপার। অখুশি হলে ক্রুদ্ধ হয়ে শাপশাপান্ত করার অভ্যাস তাঁর আছে। এই মহাতেজা মুনির সেবার দায়িত্ব কুন্তীভোজ তাঁর নিতান্তই কিশোরী কন্যা কুন্তীর ওপর ন্যস্ত করেন। এর থেকে মনে হয় কুন্তী বিদুষী, ধীমতি এবং সেবা পরায়ণা ছিলেন। তা না হলে এতো বড়ো দায়িত্ব কিছুতেই কুন্তীভোজ কন্যাকে দিতেন না। কুন্তী তাঁর পিতার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে ছিলেন। কুন্তীর পরিচর্যায় দুর্বাসা সন্তুষ্ট হন। আশীর্বাদ স্বরূপ কিশোরী অনভিজ্ঞা কুন্তীকে তিনি একটি অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দেন। এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে তিনি যে দেবতাকে স্মরণ করবেন তিনি তৎক্ষণাৎ এসে উপস্থিত হবেন এবং তার সান্নিধ্যে কুন্তী পুত্রলাভ করবেন। ব্যাসদেবের লেখনীতে এই ছোট্ট অথচ অমোঘ আশীর্বাদের ফল বা পরিণতি মহাভারতের অন্তিম পর্বে সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে তুলেছে। নিতান্তই কৌতূহলবশতঃ মন্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে কুন্তী সূর্যদেবকে আহ্বান করেন। এরফলে কুন্তী সূর্যের ঔরসে এক পুত্রের জন্ম দেন। পুত্রটি কবচ কুন্ডলধারী ছিল। তার নাম হল কর্ণ। লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী একটি পাত্রে করে তাঁর শিশুপুত্রকে নদীতে ভাসিয়ে দেন।
সূতবংশীয় অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা এই সন্তানকে বসুষেণ নাম দিয়ে পুত্রস্নেহে প্রতিপালিত করেন। কুন্তীর এই ঘটনা ব্যাসদেবের লেখা থেকেই জানা যায়। তবে এটা জানা যায় না যে কুন্তীর মাতৃত্বকালীন পর্ব রাজ অন্তঃপুরে কিভাবে গোপন রাখা হয়েছিল অথবা এই শিশুর প্রতি কুন্তীর আদৌ কোনো মাতৃস্নেহ ছিল কি না। পরবর্তীতে তিনি আগের মতোই রাজকন্যা সুলভ গুণাবলীর চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন। ফলে তাঁর সৌন্দর্য ও বৈদগ্ধ্যের খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই সময়ে যখন কুন্তী নিতান্তই কিশোরী সেই সময়ে এক বিচিত্র ঘটনা ঘটে। সব কিছুই সম্ভবত দৈব নির্ধারিত। তা না হলে মহাভারতের মতো জটিল উপাখ্যান তৈরি হবে কি করে। একদিন মহর্ষি দুর্বাসা অতিথি রূপে উপস্থিত হলেন রাজা কুন্তীভোজের রাজ্যে। দুর্বাসা অতি উগ্র স্বভাবের এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করা দুরূহ ব্যাপার। অখুশি হলে ক্রুদ্ধ হয়ে শাপশাপান্ত করার অভ্যাস তাঁর আছে। এই মহাতেজা মুনির সেবার দায়িত্ব কুন্তীভোজ তাঁর নিতান্তই কিশোরী কন্যা কুন্তীর ওপর ন্যস্ত করেন। এর থেকে মনে হয় কুন্তী বিদুষী, ধীমতি এবং সেবা পরায়ণা ছিলেন। তা না হলে এতো বড়ো দায়িত্ব কিছুতেই কুন্তীভোজ কন্যাকে দিতেন না। কুন্তী তাঁর পিতার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে ছিলেন। কুন্তীর পরিচর্যায় দুর্বাসা সন্তুষ্ট হন। আশীর্বাদ স্বরূপ কিশোরী অনভিজ্ঞা কুন্তীকে তিনি একটি অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দেন। এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে তিনি যে দেবতাকে স্মরণ করবেন তিনি তৎক্ষণাৎ এসে উপস্থিত হবেন এবং তার সান্নিধ্যে কুন্তী পুত্রলাভ করবেন। ব্যাসদেবের লেখনীতে এই ছোট্ট অথচ অমোঘ আশীর্বাদের ফল বা পরিণতি মহাভারতের অন্তিম পর্বে সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে তুলেছে। নিতান্তই কৌতূহলবশতঃ মন্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে কুন্তী সূর্যদেবকে আহ্বান করেন। এরফলে কুন্তী সূর্যের ঔরসে এক পুত্রের জন্ম দেন। পুত্রটি কবচ কুন্ডলধারী ছিল। তার নাম হল কর্ণ। লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী একটি পাত্রে করে তাঁর শিশুপুত্রকে নদীতে ভাসিয়ে দেন।
সূতবংশীয় অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা এই সন্তানকে বসুষেণ নাম দিয়ে পুত্রস্নেহে প্রতিপালিত করেন। কুন্তীর এই ঘটনা ব্যাসদেবের লেখা থেকেই জানা যায়। তবে এটা জানা যায় না যে কুন্তীর মাতৃত্বকালীন পর্ব রাজ অন্তঃপুরে কিভাবে গোপন রাখা হয়েছিল অথবা এই শিশুর প্রতি কুন্তীর আদৌ কোনো মাতৃস্নেহ ছিল কি না। পরবর্তীতে তিনি আগের মতোই রাজকন্যা সুলভ গুণাবলীর চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন। ফলে তাঁর সৌন্দর্য ও বৈদগ্ধ্যের খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।কুন্তী সর্বগুণ সমন্বিতা পরমা সুন্দরী হয়ে ওঠেন। কুন্তীভোজ তাঁর পালিতা কন্যার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেন। কুন্তীভোজ হস্তিনাপুর রাজবংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে অতিশয় আনন্দিত হয়ে ওঠেন। পাণ্ডু কিন্তু রাজা হওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন না। তিনি বীর ছিলেন। কিন্তু শারীরিক দিক দিয়ে কিঞ্চিৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সম্ভবত তিনি পাণ্ডু রোগে অর্থাৎ জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্যভার দিয়ে পাণ্ডু তাঁর দুই পত্নী কুন্তী ও মদ্ররাজ শল্যের ভগিনী মাদ্রীকে নিয়ে অরণ্য বাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ব্যাসদেবের লেখনী এই পর্বে মহাভারতের আখ্যানে আর একটি চমক সৃষ্টি করেন। অরণ্যবাস কালে তিনি মৃগয়ায় রত থাকাকালীন কিমিন্দম মুনিকে স্ত্রী-সাহচর্যে ব্যাপৃত থাকাকালীন ভুল করে শরবিদ্ধ করেন। তিনি পাণ্ডুকে অভিশাপ দেন পাণ্ডু কখনই পুত্রের পিতা হতে পারবেন না। এই পর্বে কুন্তী পাণ্ডুকে দুর্বাসার আশীর্বাদের কথা জানান, যার ফলে কুন্তী পুত্রবতী হতে পারবেন। কিন্তু একথা তিনি পাণ্ডুকে জানান না যে তিনি কৈশোরেই এই আশীর্বাদের ফলে পুত্রবতী হয়েছেন। কুন্তীর মানসিকতা বড়োই বিচিত্র। কৈশোরে যে পুত্রের জন্ম তিনি দিয়েছেন তার সম্পর্কে একটা শব্দও তিনি উচ্চারণ করেন নি। গোপনে নির্জনে এই শিশুর স্মৃতি তাঁকে উদ্বেলিত করত কিনা তাও জানা যায় না। অসম্ভব গোপনীয়তা ছিল কুন্তীর চরিত্রে।পাণ্ডু তখন পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হতে মরিয়া। তিনি কুন্তীকে অনুনয় করেন ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্ম দিতে। ক্ষেত্রজ সন্তান শাস্ত্র অনুমোদিত। কুন্তী ধর্মকে আহ্বান করেন এবং তার ফলে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। বায়ুকে আহ্বান করেন এবং পবনপুত্র ভীমের জন্ম হয়। ইন্দ্রকে আহ্বান করে কুন্তী অর্জুনকে লাভ করেন। মাদ্রী অশ্বিনী কুমারদ্বয়কে স্মরণ করে নকুল ও সহদেব নামে দুটি যমজ সন্তানের জননী হন। এই ভাবে পঞ্চপাণ্ডব হস্তিনাপুরের রাজবংশের আর একটি ধারা তৈরি করেন। অরণ্যবাসের সময়ে পাণ্ডুর মৃত্যু হয় এবং মাদ্রী সহমৃতা হন। পাঁচটি নাবালক সন্তান নিয়ে কুন্তী সুদীর্ঘকাল পরে হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন।
হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র এবং পাণ্ডু-পুত্ররা ভীষ্মের অভিভাবকত্বে এবং দ্রোণের তত্ত্বাবধানে অস্ত্রশিক্ষা এবং রাজকীয় আচরণ শিক্ষা করতে থাকেন। বিদূর পাণ্ডু পুত্রদের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। উপযুক্ত সময়ে তারা যখন রাজসভার প্রাঙ্গণে তাদের অস্ত্রশিক্ষার নৈপুণ্য প্রদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন সেই সময়ে এক তরুণ রঙ্গভূমিতে হঠাৎ এসে অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। তরুণের পরিচয় দ্রোণাচার্য জানতে চাইলে তিনি বলেন তাঁর নাম কর্ণ। সূতরাজ অধিরথ তাঁর পিতা এবং মাতার নাম রাধা। দ্রোণাচার্য বলেন ক্ষত্রিয় সন্তান কখনই সূতপুত্রের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় না। দুর্যোধন তখনই কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং কর্ণকে মিত্ররূপে গ্রহণ করেন। কর্ণের কবচকুন্ডল দেখে কুন্তী কর্ণকে চিনতে পারেন এবং মূর্ছা যান। এই ডামাডোলে অর্জুন এবং কর্ণের শক্তি পরীক্ষা স্থগিত থাকে। আশ্চর্যজনক ভাবে কর্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে। আর কর্ণ দুর্যোধনের প্রিয় সহচর হয়ে ওঠেন। কুন্তী সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে থাকেন। তিনি পুত্রদের একবারও জানান না যে কর্ণ তাঁর সন্তান এবং পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। কর্ণ দুর্যোধন তথা হস্তিনাপুরের কুরুকুলের পক্ষে থেকে পাণ্ডব বিরোধিতা করতে থাকলেন। কুন্তী এই বিপর্যয় থেকে হস্তিনাপুরকে নিশ্চয়ই রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু কিশোরী বয়সের ভ্রমবশতঃ যে সন্তানের জননী তিনি হয়ে ছিলেন তাকে স্বীকার করতে সম্ভবত তাঁর লজ্জা হয়েছিল। যে শুভ্র অকলঙ্কিত স্বামী অনুরক্তা বৈধব্যের আবরণে নিজেকে আবৃত রাখা এক মর্যাদাময়ী চরিত্র তিনি নিজের জন্য গড়ে তুলে ছিলেন, তাকে কর্ণের জন্য নষ্ট করতে তিনি চাননি। তাঁর জননীসত্তা এখানে কোনও কাজ করেনি।রবীন্দ্রনাথ তাঁর কর্ণকুন্তী সংবাদ কবিতায় কর্ণ ও কুন্তীর প্রথম সাক্ষাতের এক ভারী মনোগ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন।
কর্ণ বলছেন -
"পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার
বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,
অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত
সেই আমি - কহো মোরে
তুমি কে গো মাতঃ"।
কুন্তী এই প্রথম সূর্য যখন অস্তাচলে তখন কর্ণের কাছে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করলেন। তিনি কুন্তী। পাণ্ডবজননী। কিন্তু কর্ণ তাঁর কিশোরী বয়সের প্রথম সন্তান। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি তাঁকে স্বীকার করেন নি। কিন্তু এই মহা সংগ্রামের মুহূর্তে তাঁর ভিক্ষা তিনি কর্ণকে জ্যেষ্ঠ পুত্রের আসনে বসাবেন। সিংহাসনে বসবেন কর্ণ আর পঞ্চপাণ্ডব থাকবেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর, সুহৃদ ভ্রাতা। কর্ণ কুন্তীর অভিপ্রায় বুঝতে পারলেন। পাণ্ডবজননী পুত্রদের নিয়ে শঙ্কিত। কর্ণ বললেন -
"মাতঃ, করিয়ো না ভয়।
কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়।
...যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে
কোরো না আহ্বান।
জয়ী হোক,
রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান -
আমি রব নিষ্ফলের
হতাশের দলে।"
কর্ণ কুন্তীকে আশ্বাস দেন তাঁর একমাত্র প্রতিপক্ষ অর্জুন। বাকি পাণ্ডব পুত্রদের সাথে তাঁর কোন সংঘাত নেই। তবে কর্ণ জানতেন অর্জুনের কাছে তাঁর পরাজয় নিশ্চিত। গুরু পরশুরামের অভিশাপে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের ব্যবহার উপযুক্ত সময়ে তাঁর মনে পড়বে না। সেকথা না বলে কুন্তীকে বললেন -
"শুধু এই আশীর্বাদ
দিয়ে যাও মোরে,
জয়লোভে, যশোলোভে, রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।"
কুন্তী পরম নিশ্চিন্তে হস্তিনাপুর রাজগৃহে ফিরে আসেন। কর্ণের বিনিময়ে পঞ্চপাণ্ডবের প্রাণ তিনি রক্ষা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কি বিচিত্র জননী চরিত্র এই কুন্তীর।
আঠারো দিনের যুদ্ধে কৌরবকুল নিশ্চিহ্ন হল। কর্ণ মৃত। অর্জুন তাকে বধ করে উল্লসিত। যমুনা তীরে ক্ষত্রিয়দের দাহকার্যের সময়ে কর্ণ একাকী। তাঁকে সৎকার করার কেউ নেই। কারণ কর্ণ পুত্রহীন। এই প্রথম কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেন কর্ণের মুখাগ্নি করতে। কেননা কর্ণ তাঁর প্রথম সন্তান। ভ্রাতৃহত্যার অপরাধে অর্জুন হাহাকার করে উঠলেন। ভীম নকুল সহদেব শোকে মুহ্যমান হলেন। যুধিষ্ঠির বেদনায় বিদীর্ণ হয়ে কুন্তীকে অভিযোগ করলেন কেন এই নির্মম অমানবিক আচরণ তিনি করলেন। অভিশাপ দিলেন কোনো নারী যেন কখনই কুন্তীর মতো সত্য গোপন করে না থাকেন। দ্রৌপদী কর্ণের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে কুন্তীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। কারণ এই নারীর জন্য তাঁকে সারাজীবন পঞ্চস্বামীর স্ত্রী হিসাবে উপহাস সহ্য করতে হয়েছে। অথচ কৈশোর থেকেই সামাজিক রীতি উল্লঙ্ঘন করে যে জীবন কুন্তী যাপন করেছেন, তার জন্য তাঁকে কোনও কটুবাক্য শুনতে হয় নি। কুন্তীর পুত্রেরা মাতৃভক্ত। বিদুর সর্বদা তাঁকে আগলে রেখেছেন। হস্তিনাপুরে তাঁর কোনও অমর্যাদা হয়নি। সর্বোপরি কুন্তী পঞ্চসতীর একজন। দ্রৌপদী ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন।
অথ কুন্তী চরিত্রম সমাপ্তম।।