ভূমিকা
মন চলো নিজ নিকেতনে লেখাটি সম্পূর্ণ দেহ এবং মনের উপর মানুষের প্রভাব। এই লেখনিটিতে লেখকের সামান্য অনুভূতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে । বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মহামানবের কথার এবং বাণীর মাধ্যমে লেখাটি পরিস্ফুট করা হয়েছে। বলতে গেলে এক কথায় লেখাটি "গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা করা হয়েছে।" বর্তমান অত্যাধুনিক সমাজে, তামাম দুনিয়াতে, বিশ্বায়নের প্রভাবে মানুষের প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা আস্তে আস্তে মান - হুঁস (মানুষ) থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমশ কম্পিউটারের ভাষায় ডিলিট হয়ে যাচ্ছে। দেহ ও মন নিয়ে মানুষের জীবন। লেখকের স্বরচিত কবিতা দিয়ে ভূমিকার ইতি টানছি। 'জীবন আসে, জীবন থেকে - একথা জানে সবাই কিন্তু, দেহ থেকে জীবন গেলে থাকে শুধু একতাল রক্তমাংস অন্তর্জলী যাত্রার অপেক্ষায়।'
পেটের জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্য পেট। সুর, তাল, ছন্দ যার যেমনতর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জীবন তার তেমনতর। ভোগ নিয়ে জীবন যার, দুর্ভোগ নিয়ে মরণ তার। আবার এমন জীবন করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন। দেহ আছে কিন্তু মন ভালো নেই। আবার অন্যদিকে দেহ সুস্থ নয় তাই মনও ভালো নয়। সেকারণে দেহ-মন একে অপরের পরিপূরক। দেহতে মশা বসেছে কিন্তু মন বলছে শরীরে মশা বসেছে ওকে সরিয়ে দে। মন দেহের থেকে বড় ভাইটাল কাজ করে। মন আলোর গতিতে ছুটে চলে। মন বলছে এখন দিঘা, মর্তের বৈকুন্ঠধাম পুরী যাব কিংবা বিদেশ বেড়াতে যাব অর্থাৎ মন সবার আগে ছোটে। আবার মন বলছে অশান্ত না হয়ে শান্ত হও। অন্যদিকে অশান্তির আগুনে জর্জরিত মন দগ্ধ হয়, ক্রুদ্ধ হয়। শুরু হয়ে যায় রক্তচাপ, মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, নিদ্রাহীনতা, উদ্বেগ, অবসাদ ইত্যাদি। একশত বৎসর আগে মানুষের মনে ধৈর্য ও সহনশক্তির জন্য প্রত্যেক পরিবারের যে শান্তি ছিল তা আজ হারিয়ে গেছে।
এর অন্যতম প্রধান কারণ ক্রোধ। "Anger is one letter short of Danger". অর্থাৎ Anger-এর সাথে D লাগালে হয় Danger. ক্রোধ মানসিক অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ। ক্রোধের ফলে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।
এই মুহূর্তে বিশ্বমহামানব স্বামী বিবেকানন্দের গানের কলিতে বলি, মন চলো নিজ নিকেতনে। মনে আসে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য। এই ষড়রিপুর দাস আমরা। তাই মনকে ঠিক করতে হবে, তুমি কি চাও? ধ্যানের মাধ্যমে, গানের কলিতে, আধ্যাত্মিক সংগীতে বলি - শুধু চলা, জীবনের পথ চলা নয়তো - দাঁড়াও পথিক কোন পথে যাবে আগে করো ঠিক। ধ্রুবতারা ভুলে যদি চলো শুধু পথ। পথে পথে ঘুরিবে পথিক। দাঁড়াও পথিক কোন পথে যাবে আগে করো ঠিক।
এই পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। তাই অহংকার কিসের জন্য? অহমিকা, মানুষ-মানুষকে চমকানো, পৃথিবী থেকে সুপারি কিলার দিয়ে মানুষকে সরিয়ে দেওয়া। তাতে মানুষের দেহটা পড়ে থাকে কিন্তু শরীর থেকে, দেহ থেকে পূর্ণ আত্মাটা বেরিয়ে যায়। ক্ষতি তার, যে মানুষটা অপর মানুষের, দুর্বল মানুষের ক্ষতি করছে। জীবনে অশান্তি ও হতাশা আমাদের অনেক পিছিয়ে দেয়। আমার থেকে কত অনেক Below Quality মানুষ কিভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত, কেরিয়ারের চরম শিখায় আসীন, তাহলে আমার কেন এই অবস্থা? তাই পরিস্থিতি মেনে নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
স্বামী বিবেকানন্দের কথায় বলি - "পরিস্থিতি মেনে নাও এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকো। মনে করতে হবে আমার থেকেও অনেকে আরও অনেক বেশি কষ্টে আছে। আমি কেন পারব না? চাওয়াটা না পাওয়াই দুঃখ। কিছু চেয়ো না। সব অবস্থায় রাজি থাকো, দুঃখ তোমার কি করবে? দুঃখ কারো প্রকৃতিগত নয়কো। তাকে ইচ্ছে করলেই তাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরম পিতার কাছে প্রার্থনা করো - তোমার ইচ্ছাই মঙ্গল, আমি জানি না কিসে আমার মঙ্গল হবে। আমার ভিতরে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, আর তার জন্যে তুমি রাজী থাকো। আনন্দে থাকবে, দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করবে না।
মহাভারতের কুন্তীকেও দেখেছি তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন, "দুঃখই দাও ঠাকুর, দুঃখ না দিলে তোমায় ভুলে থাকবো"। মানুষের নিজের বলতে কি আছে? জন্ম-সে অন্যজনের দান । নাম-সেও অন্যজনের দান। শিক্ষা -সেও অন্যজনের দান। রোজগার- অন্যজনের পয়সায়। শেষ যাত্রা (মৃত্যু) সেও অন্য কেউ নিয়ে যাবে। খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। মাটির এই পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। তাই অহংকার কিসের জন্য? জীবনে অশান্তি ও হতাশা আমাদের অনেক পিছিয়ে দেয়। যা থেকে মুক্তি দেয় ধ্যান, শবাসন এবং অনবরত ঈশ্বরের নাম ও তার গুণকীর্তনে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় বলি, "নাম কর মনে, বনে এবং কোনে।" অপরের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমরা ক্রোধ করি। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা এই সত্যকে বুঝতে পারি, প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিয়ে এসেছে। আমরা জানি এই পৃথিবীতে যা আমার আছে, কাল তা অন্যজনের । গীতারই কথা, তুমি কি হারিয়েছো যার জন্য কাঁদছো? তুমি কি নিয়ে এসেছিলে যা তুমি এখানে হারিয়েছো? তুমি খালি হাতে এসেছো, তোমাকে খালি হাতে যেতে হবে। সঙ্গে শুধু আমরা নিয়ে যাই প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করা। সঙ্গে নিয়ে যাই প্রকৃত জ্ঞান, গুণ, সংস্কার। এই সত্যকে অনুভব করার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ধ্যান বা প্রাণায়াম এবং শবাসন। শবাসনে মনে করতে হবে আমি নেই -পৃথিবী নেই । যদিও ভুলে কখনো গর্ব হয় এই ভেবে যে আমি ছাড়া দুনিয়া অচল। দেওয়ালে টাঙানো পূর্বপুরুষদের ছবির দিকে মনে মনে তাকাও, চর্মচক্ষে দেখো- উত্তর পেয়ে যাবে। তারা নেই বলে কি দুনিয়া থেমে আছে?
চুরাশি লক্ষ প্রাণীর বাস এই পৃথিবীতে। মানুষ শুধু রোজগার করে। বাকি প্রাণীরা কিন্তু অনাহারে মরেনা। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা জীব শ্রেষ্ঠ, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সেই উৎকৃষ্ট মানুষ যার পেট ভরে না-মনও ভরে না। মনকে উৎসাহিত ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশ্বত কবিতায় বলি - "সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মল প্রাণে। জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে, সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দ গানে। সংকটে - সম্পদে থাকো কল্যাণে, থাকো আনন্দে নিন্দা -অপমানে। সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে, চির অমৃত নির্ঝরে শান্তিরস পানে।"
ঠাকুর আজ আমরা মানুষ নামক জীবটা আনন্দে থাকতে পারিনা । হাসি ভুলে গেছি প্রতিযোগিতার বাজারে। যে হাসি আমরা হাসি নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীর হাসির মতো সেটি হল মেকি হাসি। শহরে এখন কৃত্রিম হাসির ক্লাব হয়েছে, সেটি হল লাফিং ক্লাব তাতে হাসতে হবে। হাঁটতে ভুলে গিয়েছি মাইলের পর মাইল মেঠো রাস্তা পেরিয়ে। বাইক ছাড়া এক মুহূর্ত হাঁটতে পারি না। আমরা রুটিন মর্নিং ওয়ার্ক করি পাঁচ জনের সঙ্গে পাঁচ মেশালি গল্প করতে করতে। সকাল সন্ধ্যায় দু'কিলোমিটার হাঁটি। চায়ের দোকানে এক ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিই নানা রাজনৈতিক গল্প, কার বাড়ির কি হয়েছে, কে কার ঘটি হারিয়েছে। হরি কথা ভুলে গিয়েছি। যেখানে শতরূপে মা সারদার লীলা সঙ্গিনী গৌরী মাতা বলেছেন, "হরি কথাই হলো আসল কথা। আর বাকি সব বাজে কথা।" আমরা হরি কথা বলি না, মরার সময় মৃত্যুমুখি মানুষকে বলা হচ্ছে - একবার হরি বল, একবার কৃষ্ণ বল, বলতে পারছে না। বলার অভ্যাস নেই। কীর্তনীয়ার সুরে বলতে হবে- "ওর হয়ে বল, হরিবল। একবার কৃষ্ণ বলে, বাহু তুলে, নাচরে মন পথে পথে।" ঠাকুর আজকের পৃথিবীটা দাঁড়িয়ে আছে লেকচার, পিকচার, মিক্সচারের উপর। ঠাকুর আমাদের মন মুখ এক নয়। মুখে এক বলছি, মনে আর এক করছি। আমরা এখন আর প্রিয়জনদের কিংবা প্রেমিক প্রেমিকাকে চিঠি লিখি না। চিঠি লেখা ভুলে গিয়েছি। শ্রীচরণেষু বাবা, শ্রীচরণেষু মা, শ্রদ্ধাভাজনেষু দাদা ইত্যাদি লিখিনা। শুধু এসএমএস করি। যন্ত্র চালিত মানুষ হয়ে গেছি কখন তা নিজেও জানিনা। অথচ Man is more powerful than Machine. আমরা সিনেমা হলে দিদি জামাইবাবু, ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে সিনেমা বা যাত্রা শুনতে যাইনা। যাত্রা শিল্প প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। এখনকার বাড়ির মেয়েরা বা মায়েরা তুলসী তলায় সন্ধ্যে দেওয়াটা বিকেল বেলায় দিয়ে দেয়। সন্ধ্যা দেয় পটল কুমার গানওয়ালা। এখনকার মেয়েরা বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী চরিত্র পড়ে না। কি করে ঠাকুর "ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে"। ঠাকুর আমরা এখন তেলা মাথায় তেল দিচ্ছি। রুক্ষ মাথায় তেল দিলে তেল বেশি খাবে। ধ্যানসিদ্ধ মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন যুবক বয়সী হলো ধর্ম সাধনার, ঈশ্বর সাধনার একমাত্র সময়। আবার আরেকজন বলছেন - এই বয়সে কি ধর্মকর্ম, দীক্ষা, ধ্যান, প্রাণায়াম? ওসব বৃদ্ধ বয়সে হবে। আরে ধর্ম হলো দুর্বল লোকের, পাগল, অসুস্থ লোকের আফিম। ওদের বারোটা বেজে গেছে। প্রখ্যাত রস সাহিত্যিক, ভক্ত সাহিত্যিক শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথাই বলি - বারোটা তখনই বাজে যখন ঘন্টার কাঁটা ও মিনিটের কাঁটা এক হয়। বোধ হয় আমাদের মন মুখ এক হতে চলেছে।এখন শুধু ভোগ কর। খাও, পিও, জিও। আমরা ভোগটাও বাস্তবে ঠিকমতো করতে জানিনা। তাই ভোগ হয় দুর্ভোগে, সুখ হয়- অসুখে। শান্তি আমরা পাই না। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শ্রীশ্রী মা সারদার কথাটি, "যদি শান্তি পেতে চাও, কারো দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের, জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার। এই অমূল্য, মহামূল্যবান, চিরন্তন, শাশ্বত বাণীটি তামাম দুনিয়ার মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় অমৃত দাওয়াই। বেঁচে থাকার, শান্তিতে, সুখে স্থির থাকার মোক্ষম দাওয়াই।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ভারতের মহান পুরুষ মহাত্মা গান্ধীর কথা। "আমি ক্রুদ্ধ হই না, তা নয়। তবে ক্রোধ প্রকাশ করি না, ক্রোধ শূণ্য হবার জন্য আমি ধৈর্যের চর্চা করি, সাধারণত সফলও হই। এ নিয়ন্ত্রণ করা কেমন করে আমার পক্ষে সম্ভব হয়, সে প্রশ্ন অবান্তর। কেননা এটা একটা অভ্যাস, যা সকলেরই চর্চা করা উচিত। নিরন্তর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এ - গুণ অর্জনে সফল হতে হবে।" ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা, "পিঁপড়ের মতো হয়ে সংসারে থাকবি। এই সংসারে নিত্য অনিত্য মিশিয়ে রয়েছে। বালিতে চিনিতে মেশানো রয়েছে পিঁপড়ে হয়ে চিনিটুকু নেবে। জলে দুধে মিশে রয়েছে হংস হয়ে শুধু দুধটুকু নেবে। আমাদের সৎ চেতনার চৈতন্য হয়নি ঠাকুর আজও পর্যন্ত। আমরা জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ - সংসার বদ্ধ জীব। লাখ ধান্দায় মনটি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তোমাকে ডাকার, তোমার নাম স্মরণ, মনন করার সময় ও ধ্যান করার সময় কোথায়? আমরা টাকা - পয়সা, আভিজাত্যে, প্রাচুর্যে, সম্পদে, গাড়িবাড়ি, সম্মানে বড় হয়েছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ হইনি। যেখানে বিবেকানন্দ বলেছেন, "এসো মানুষ হও"। মানুষ মানে একতাল মাংস নয়, মানুষ সর্বশক্তিমান, পবিত্র, এক অসীম শক্তি। মানুষ রেখে যাবে তার জীবনের কোন আদর্শ বা চিহ্ন। ইংরেজিতে যাকে বলছে মার্ক। কোথায় সেই মার্ক বা চিহ্ন। স্বামীজীর কথা, "জীবনে এসেছো যখন একটা দাগ কেটে যাও"।
আগেকার মা ঠাকুমার লেখা ফটোতে সুতোর কাজে লেখা থাকতো, "এমন জীবন করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি - কাঁদিবে ভুবন"।
জীবন গঠনতো পরের কথা। নিজের স্বার্থ, নিজের চেয়ারের চমকানি, মানুষকে চমকিয়ে রাখা। কাকে চমকাচ্ছ - নিজেকে নিজে চমকাচ্ছ, কাকে ঠকাচ্ছ - নিজেকে নিজে ঠকাচ্ছ। আর বলছ, "এই বেশ ভালো আছি"। তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান এই আমাদের পৃথিবী। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে। এখন হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। বাবা মা থেকে সন্তান আলাদা। বাইরে ফ্ল্যাট কিনেছে বাবা মা ভুলে। তাদের ছেলেমেয়ে দাদু ঠাকুমার স্নেহ থেকে, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত সেই দুধের বাচ্চা গুলো যখন বড় হচ্ছে, তারাও একই পথের দিশারী হচ্ছে। আমার বাবা-মা তো তাদের বাবা মাকে দেখেনি, ওল্ডেজ হোমে যাকে বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে। আমরাও ঠিক তাই করব। তাই দেশ থেকে, সমাজ থেকে পরিবার, নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না।
চলো যাই কিছু করে দেখাই না হয়ে, চলো যাই কিছু করে খাই। এখন মানুষ শিক্ষিত হয়েছে। নামের পিছনে বিশাল ডিগ্রী লাভ করেছে। ডক্টর অমুক, ডক্টর তমুক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ হয়নি। লেখাপড়ায় দড় হলে - শিক্ষা তারে কয় না। অভ্যাস, ব্যবহার -সহজ জ্ঞান না হলে শিক্ষা হয় না। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় "প্রতিষ্ঠা সে তো শূকরী বিষ্ঠা"। ডিগ্রী সেতো নামের পিছনে ল্যাজ মাত্র। তুমি কতখানি মানুষ, কতখানি তোমার মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতা সেটিই হল বড় কথা। আমরা আগেকার মা ঠাকুমার নীতি শিক্ষা কি পেয়েছি?
অকূলে পড়িলে দীনহীন জনে, নোয়াইও শির, কহিও কথা, কুল দিতে তারে -সেধো প্রাণপণে, লক্ষ্য করিও - তার নাশিও ব্যথা।
আমরা কি স্বামী বিবেকানন্দের সেই অগ্নিবাণী মনে রাখতে পেরেছি, "তামাম দুনিয়ার মানুষ যদি তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তুমি কি তৈরী এক আদর্শ বা সত্যের জন্য? সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু কোন কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।" You are for the lord not for others, you are for the lord so for others.
আমরা কি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে কণ্ঠ মিলিয়ে কিংবা গলা মিলিয়ে গাইতে পারি? যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে। আমরা অনেকেই ২৫ ডিসেম্বর ভগবান যীশু খ্রীষ্টের জন্মদিন পালন করি। তার স্মরণ, মনন করি খাও, পিও, জিও দিয়ে। আমরা কি সেই দিনটায় একটুও চোখের জল ফেলেছি প্রভু যীশুর জন্য। ভগবান যীশুর ফটোর কাছে বসে, চার্চে বসে প্রার্থনা করেছি কি? হে প্রভু আমায় ভালো করো। আমায় সহ্য শক্তি দাও। এ কথা আমরা বলি না, এই জন্যই আমরা ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত হই। ভগবান যীশু বাইবেলে বলেছেন- "আমি সকলের দোরগড়ায় যাই এবং সবাইকে ডাক দিই। যে আমার ডাক শুনে ভেতরে ডাকেন আমি কেবলই তার কথা শুনি।" ভগবান যীশু ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে আর বলছে, "হে প্রভু, ওদের ক্ষমা করো ওরা জানে না ওরা কি করছে?" ঈশ্বর তোমায় বাসেন ভালো, তাতে তোমার কি? তুমি যদি না তাকে বাসো ভালো - ভস্মে ঢালো ঘি।
আজকের দুনিয়ায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের যুগে, অ্যাংজাইটির যুগে, ইমেইল, ফ্যাক্স, স্যাটেলাইটের যুগে, এসএমএসের যুগে, ফেসবুক, চ্যাটের যুগে, মোবাইলের যুগে, কম্পিউটার এবং কেবলকর্মের যুগে দুনিয়া মুট্টিমের যুগে - ধর্ম, মেডিটেশন কিংবা ধ্যান বা প্রাণায়াম জাহান্নামে যাক। কে কত রাতারাতি ধনী হয়ে উঠতে পারে। এই ভোগবাদীর যুগে কে কাকে কতখানি ল্যাং মেরে বড়লোক হতে পারে বা ক্যারিয়ারের চরম শিখায় উঠতে পারে। সম্মানের উচ্চ শিখরে উঠতে পারে। তারই প্রতিযোগিতা চলছে। মানুষের মানসিক চাপ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ ধীর, স্থির নয়। শুধুই ব্যস্ত মোবাইল ঘাঁটায়, ব্যস্ত ল্যাপটপ ঘাটায়, ব্যস্ত পৃথিবীর সব খবর তাকে জানতে হবে। হরি কথা ভুলে গেছে, ঈশ্বরের কথা ভগবানের নাম ভুলে গেছে।মানুষ শিখেছে গিভ এন্ড টেক পলিসি। কি পেলাম, কি দিলাম। মানুষ বলছে হয় টাকা দে, নয় দেখা দে। তুমি যদি সৎ হও তোমার দেখা দেখি হাজার হাজার লোক সৎ হয়ে পড়বে। আর যদি অসৎ হও তোমার দুর্দশার জন্য সমবেদনা প্রকাশের কেউ থাকবে না। কারণ তুমি অসৎ হয়ে তোমার চারিদিকে অসৎ করে ফেলেছ।
প্রকৃতি যতনা মানুষ মারে, মানুষ মানুষকে তার থেকে বেশি মারে সেটা দৈহিকভাবে কিংবা মানসিকভাবে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, ঠাকুর আমাদের স্বভাব ইঁদুরের মতো হয়ে গেছে, শুধু কাটা স্বভাব, জুড়তে শিখি না। মানুষ পরচর্চা পরনিন্দায় চায়ের দোকানে মেতে উঠেছে অথচ মহাপুরুষরা বলছেন পরচর্চা করা মানে পরের দোষ কুড়িয়ে নিয়ে নিজে কলঙ্কিত হওয়া। পরচর্চা মানে আত্মচর্চা থেকে বঞ্চিত হওয়া। আমরা আত্মসমালোচনা করি না। স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, আত্মবিশ্লেষণ করি না । নিজের সঙ্গে নিজে পাঁচ মিনিট জীবন জিজ্ঞাসা করি না। ঠাকুর আজকের দুনিয়াতে "নাইট ক্লাব" হয়েছে আনন্দ ফুর্তির জন্য। ঠাকুর এখন গ্রামগঞ্জেও "ডান্স হাঙ্গামা" চালু হয়ে গিয়েছে। যত রাত্রি হয় ঘোষকেরা বলতে থাকেন মা-বোনেরা বাড়ি চলে যান। যুবক দাদা ভাইদের জন্য রসদের গান ও নাচ আরম্ভ হবে। ফুল টাওয়ার, একেবারে সুতোবিহীন নৃত্য। বিকিনি পড়ে ১৬-১৮ বছরের মেয়েরা নৃত্য করছে। মেয়েরা এখন বিকি আর কিনি হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে। কোথায় গেল সতী, সাবিত্রী, সীতা, দময়ন্তী এবং মা সারদা। দূরদর্শন খুললে দেখছি বিজ্ঞাপন চলছে তোরা সাত দিনে চারবার খাট ভেঙেছিস? কার্পেন্টার খাট সারাছে খটাখট করে। ব্যবহার করুন এক্স ক্যাপসুল, ওয়াই তেল। পরিবার নিয়ে টেলিভিশন একসঙ্গে বসে দেখা যায় না ও শোনা যায় না। আজকের মা বাবা- ছেলেমেয়েদেরকে ধমক দিতে পারবে না, স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা প্রয়োজনে ছাত্র-ছাত্রীদের বকাঝকা কিংবা একটু শাস্তি, মারধর করতে পারবে না। করলেই বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে। অথচ ঠাকুর তুমি বলছো - ভুল করে যে খায়নি ধমক, পায়নি কোনো লাঞ্ছনা, ভুল তাহারে ভুলিয়ে নিয়ে করেই জ্ঞানে বঞ্চনা। আমরাই দোষী, আমরা ছোট ছোট বাচ্চা শিশুদের ছোটবেলা যখন নরম মাটি তখনই শেখাই না প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা। ভালবাসা কথার অর্থ ভালোতে বাস করা। ভালোবাসা কথার অর্থ আমরা আধুনিক প্রজন্মের মানুষ বুঝি নারী পুরুষের মাখামাখি। সেই ঐশ্বরিক ভালোবাসা কোথায়? আধো-আধো কথা যখন, করে করিয়ে যাই শেখাবি, সেইটি হবে মোক্ষম ছেলে- হিসাবে চল নয় পস্তাবি।
আজকের এই অস্থিরতার জীবনে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর জীবনে, ইন্টারনেটের যুগে, দুনিয়া মুট্টিমের যুগে, ফাস্টফুডের জীবনে, হাই, হ্যালো, বাই, চ্যাটের জীবনে, বোল্ড রিলেশনের যুগে, আমাদের বাঁচবার একমাত্র রাস্তা ধ্যান বা প্রাণায়াম।দিনের শেষে শ্রী শ্রী মায়ের অর্থাৎ জগৎজননী, লক্ষ্মী স্বরূপা, বিশ্ব মাতা মা সারদার সেই অমৃত শ্বাশ্বত বাণী, "যার নেই সে জপ, আর যার আছে সে মাপ"। আমার মনে হয় মা বলতে চেয়েছেন একটু একটু করে ধ্যানের মাধ্যমে গুড, বেটার, বেস্ট মানুষ হতে। ধ্যান হলো প্রকৃত জ্ঞান। ভালো ভালো আধ্যাত্বিক বই পড়া, সাহিত্য, ভগবত চর্চা, ভালো গান শোনা। এতে সমস্ত দুশ্চিন্তা কেটে যায়। কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, রাগ, বিদ্বেষ সব কেটে যায়। মনেতেই বন্ধন আবার মনেতেই মুক্তি। যার কোটি টাকা আছে গাড়ি-বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে কিন্তু মনে কোন সুখ নেই, শান্তি নেই। পা থেকে মাথা অবধি দৈহিক, মানসিক রোগে জর্জরিত। সে কি তাহলে টাকা চিবোবে? আমরা রেলের মালগাড়ি হয়ে গেছি। নামের গাড়ি হয়নি। তাই ঠাকুর তুমি বলছো - নামের গাড়ি চলছে তো? নাম চলছে তো? ধ্যান চলছে তো? জপ চলছে তো?
মানুষ এখন বিশ্বায়নের প্রভাবে প্রবল কর্মমুখর। বেড়েছে শরীর ও মনের ক্লান্তি। ভোগ - সুখের প্রলোভন বেড়েছে। এর সঙ্গে অর্থ উপার্জনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলেছে। মানসিক চাপ, ক্লান্তি, অবসাদ, অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। তাই দেহটা সুস্থ রাখতে মনকে সুস্থ রাখতে হবে।
"জীবনটা আর চলছে না সোজা পথে, বেঁকে গেছি বলি হতে হতে", 'ক্যাকটাস' ব্যান্ডের এই গানটির মধ্যে আমাদের জীবনের চলার রাস্তাটার গতিপ্রকৃতি পরিস্ফুট হয়েছে। বর্তমান জীবনের প্রতিটি ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়তে লড়তে এই জনসমাজ আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। ডারউইনের, "Struggle for Existence" এই নীতির প্রয়োগ করতে করতে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতি হয়ে উঠেছি বীতশ্রদ্ধ। বাঁচার রাস্তাটা আমরা নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছি আমাদের জীবন থেকে। এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা মানুষের হীনমন্যতা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা কাটাতে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য বা পথ ধ্যান, যাকে বলছি প্রাণায়াম বা মেডিটেশন। আমরা প্রকৃত ফাদার, মাদার, ব্রাদার এবং সিস্টার হতে পারি না। চার্চের ফাদার, চার্চের মা মাদার টেরেজা হতে পারি না। হতে পারি না ভগিনী নিবেদিতা। ওনারা কি কেউ আধুনিক মানুষ নয়? আমাদের মা সারদা তিনি সৎ এরও মা, অসৎ এরও মা । বিশ্বমাতা যিনি শ্রী ও শোভনতার বিগ্রহ ছিলেন। তার প্রত্যেক আচরণ ও কর্ম ছিল শ্রী এবং শোভনতার পরম উপমা। উদ্বোধনে সারদার খুব অসুখ, জনৈক সন্ন্যাসী সন্তান মাকে দেখতে এসেছেন। সারদার মাথায় কাপড় দেওয়া ছিল না। সাধুটি চলে যাওয়ার পর সারদা সেবিকাকে বললেন "আমার মাথায় কাপড় দেওয়া নেই? কাপড়টা দিয়ে দাও নি কেন? আমি কি মরে গেছি? এখনই এই করছো? এটি লোকশিক্ষার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত। শুধু নিজের আচরণ ও কর্মে নয় তার আশপাশে যেসব মেয়েরা থাকতেন তারাও যাতে শ্রী এবং শোভনতার সীমালংঘন না করেন সে বিষয়েও তাদের সচেতন করে দিতেন মা সারদা। তিনি কি তাহলে আজকের যুগে আধুনিক নারী নন? ১০০% লাভ এর মত, ১০০% আধুনিক মা ।এটাই শাশ্বত চিরন্তন মা ও মেয়েদের প্রকৃত আচরণ হওয়া উচিত। এখনকার ছেলেমেয়েরা বলবে ওটা সেকেলে। একটু পেছনে চলে যাই- স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার গুরুভগিনী পাশ্চাত্যের সারা বুল যখন কঠিন সংকটময় পীড়ায় আক্রান্ত ,একান্ত সেই দুঃখের দিনে নিবেদিতা শ্রী মাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, শ্রীমা সম্পর্কে তার এক অন্তরঙ্গ পাশ্চাত্য মহিলা ভক্তের মনোভাব কি? তিনি লিখেছেন চিঠির মাধ্যমে "আদরিনী মা, সারার জন্যে প্রার্থনা করব বলে আজ ভোরে গির্জায় গিয়েছিলাম। সবাই ওখানে যিশু জননী মেরির চিন্তা করছে, আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তোমাকে। তোমার সেই মনোরম মুখখানি, সেই স্নেহ ভরা দৃষ্টি, পরনে সাদা শাড়ি, তোমার হাতের বালা সবই যেন প্রত্যক্ষ দেখতে পেলাম, আমার মনে হল, তোমার সেই দিব্য সত্তাই যেন বেচারী সারার রোগকক্ষে নিয়ে আসবে, শান্তি ও আশীর্বাদ। আমি আরোও কি ভাবছিলাম, জানো মা? ভাবছিলাম সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ধ্যা আরতির সময় তোমার ঘরে বসে আমি যে ধ্যান করবার চেষ্টা করেছিলাম, সেটা আমার কি বোকামি না হয়েছিল। আমি কেন বুঝিনি যে, তোমার বাঞ্ছিত চরনতলে ছোট্ট একটি শিশুর মত বসে থাকতে পারাই তো যথেষ্ট ! মা গো ! ভালোবাসায় ভরা তুমি! আর সেই ভালোবাসায় নেই আমাদের বা জগতের ভালোবাসার মতো উচ্ছ্বাস ও উগ্রতা। তোমার ভালোবাসা হল এক স্নিগ্ধ শান্তি যা প্রত্যেককে দেয় কল্যাণ স্পর্শ এবং কারো অমঙ্গল চায়না ও যে লীলাচঞ্চল একটি হৈম দ্যুতি। কয়েক মাস আগেকার সেই রবিবারটি কি আশিসই না বয়ে এনেছিল। গঙ্গা স্নানে যাওয়ার ঠিক আগে আমি তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম, আবার স্নান করে ফিরে এসেই মুহূর্তের জন্য দৌড়ে তোমার কাছে গেলাম। তোমার আনন্দময় ঘর খানিতে তুমি আমায় যে - আশীর্বাদ জানালে, তা আমায় দিয়েছিল এক অদ্ভুত মুক্তির অনুভূতি। প্রেমময়ী মা। চমৎকার একটি প্রার্থনা, আহা, যদি তোমায় লিখে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু না, তাতেও মনে হয়, বড় বেশি শব্দ করা হবে, সেটা শোনাবে কোলাহলের মত। সত্যিই তুমি ভগবানের আশ্চর্যতম সৃষ্টি। শ্রী রামকৃষ্ণের বিশ্বপ্রেম ধারণের পাত্র। এই নিঃসঙ্গ দিনে তুমিই রয়েছো তার সন্তানদের কাছে প্রতীক স্বরূপ; আর আমাদের উচিত তোমার কাছে একান্ত স্তব্ধ ও শান্ত হয়ে থাকা। অবশ্য কখনো কখনো একটু আধটু মজা করা ছাড়া, বাস্তবিকই ভগবানের যা কিছু বিস্ময়কর সৃষ্টি সবই শান্ত, নীরব। গোপনে, অজ্ঞাতে তারা প্রবেশ করে আমাদের জীবনে - যেমন বাতাস ও সূর্যের আলো, যেমন বাগানের ও গঙ্গার মাধুর্য। এইসব শান্ত জিনিসই তোমার তুলনা।"
বিশিষ্ট দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক চৈতালী চন্দের ভাষায় বলি, প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা উৎস থাকা প্রয়োজন যা তাকে সর্বদা শক্তি যোগাবে। এই শক্তি হলো ধ্যান। এই শক্তি শুধু বিপদের সময় নয়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এমনকি যখন আমরা সহজভাবে, সুন্দরভাবে, চলি তখনও প্রয়োজন। আমার মনে হয় এই শক্তি একমাত্র ধ্যানের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ধ্যান ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করে। জীবনের কোন কোন সময় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আমরা খুঁজে পাই না। তখন ধ্যানই আমাদের সমাধানের রাস্তা দেখায়, নিজেকে কোনো দিব্যশক্তির কাছে তুলে ধরার জন্য ধ্যান করা একান্তই প্রয়োজন। ধ্যানের মধ্য দিয়ে আসে আত্মনিবেদন (Self Surrender) ঈশ্বরের ওপর সম্পূর্ণ নিজেকে সমর্পণ করতে পারি। ফলে জীবনের অনেক বোঝা হালকা মনে হয়। ফলে মানসিক অবসাদ, হতাশা আসে না। বাইরের সব ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। জীবনের পরমশান্তি অনুভব করার জন্য, নিস্তব্ধতা অতলে প্রবেশ করার জন্য ধ্যান ভীষণভাবে আমাদের সাহায্য করে। ধ্যান নিম্ন ভাবনা থেকে উচ্চতর কোন ভাবনার দিকে মনকে নিয়ে যায়, ধ্যানের মধ্যে দিয়ে আসে আত্মবিশ্লেষণ (Self Analysis)। ধ্যানের মধ্যে আমরা বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে কি ধরনের ভাবনা চলছে - লোভ? মোহ? না ঈর্ষা? না বদলা নেবার ভাবনা? ফলে তা দূর করার জন্য সচেষ্ট হতে পারি। ধ্যান মানুষকে সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে রাখে। ধ্যানের সময় মন ও শরীর একই সুরে বেজে ওঠে। ধ্যানের সময় সীমিত পৃথিবী মুছে যায়, আছে অসীম অনন্ত আনন্দ। ধ্যান যত গভীর হয় মস্তিষ্ক তত শান্ত হয়। যেমন অসীম নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাদের দৃষ্টিতে কেবল নীল আকাশ আসে ঠিক তেমনি ধ্যানের মাধ্যমেও আছে অসীম গভীরতা ও আনন্দ। ধ্যান যত গভীর হয় মস্তিষ্কের স্নায়ু তত প্রশান্ত হয়। ধ্যানের সময় আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওরে। ধ্যানের সময় হালকা মিউজিক আমাদের মনকে একাগ্র করে। ঈশ্বরের দর্শন পাবার জন্য মনকে আকুল হতে হয়। সহজ, সরল জীবনযাপন ধ্যান অভ্যাসে সাহায্য করে। আমাদের জীবন অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য। এর মধ্যে সব বাসনা আমাদের পূরণ নাও হতে পারে। তাই যা পেয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। মনে মনে প্রার্থনা করতে হবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় - "আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারো ঘরে, যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।" তাই আমাদের সব চিন্তা-ভাবনা ঈশ্বরের উপর অর্পণ করে বলি তোমার বাণীতে - 'ভাবছো মিছে চলবে কিসে - ভাববার তুমি কে? তোমার ভাবনা ভাবছেন যিনি - তুমি ভাবো তাকে।'
ওঁ শান্তি - ওঁ শান্তি, হরি ওঁ তৎ সৎ।