বিবিধ

মোনালিসা



অমলেন্দু হাইত


অখিলেশ আইফেল টাওয়ারের টপে(তৃতীয় স্তরে)উঠে দেখে তার স্বপ্নের প্যারিস শহরকে। যা তার কাছে বইএর পৃষ্ঠায় দেখা ছবি তা আজ বাস্তব। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সেইন নদী। শুধু অট্টালিকা আর অট্টালিকা। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে জীবনদীপ বিল্ডিং থেকে তার এগারো তলার চেম্বারে বসে কলকাতা, দূরে হাওড়া সেতু, গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে, সব যেন প্যারিসের সঙ্গে কোথাও যেন সে মিল খুঁজে পায়।

পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা শিল্প কীর্তি, সংস্কৃতি সব কিছুই ইউরোপকে ঘিরে। গত কয়েকদিন আগে অফিসের ইন্টারন্যাশনাল এল.এফ.সি. তে সপরিবারে ইটালি, ফ্লোরেন্স, মিলান, ভেনিস হয়ে পৌঁছেছে আজ ফ্রান্সে। হোটেলে চেক ইন করেই ট্যুর ইটানারী মেনে গাইডের পরামর্শে পৃথিবীর বিস্ময়কর সৃষ্টির সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মানুষের কি অপূর্ব সৃষ্টি! সাতটি লিফ্ট চলে, সবকটি একতলা থেকে নয়। তিনটি স্তরেই রেস্তোরাঁ, গিফ্ট শপ, এন্টারটেইনমেন্ট, ওয়াশরুম রয়েছে। মানুষ যাতে আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারে। প্রতিটি স্তরের জন্য আলাদা টিকিট। পায়ে হেঁটে উঠতে চাইলে ৬৭৪ টি ধাপ ১৬৬৫ টি ধাপের মধ্যে অনুমতি দেওয়া হয়। ৩২০ মিটার (১০৫০ ফুট) উচ্চতায় ঝড়ের মত হাওয়া বইছে। মাথার টুপি উড়ে যেতে চাইছে অখিলেশের। চোখ জুড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যেন সে এখন হিমালয়ের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। পাশে স্ত্রী জড়িয়ে ধরে। ছেলে মেয়েরা তীব্র হাওয়া বাঁচিয়ে কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখছে। অখিলেশদের মত আরও অনেকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে প্যারিস শহর, মুক্ত নীল আকাশ উপভোগ করছে তীব্র বাতাসের বেগকে হার মানিয়ে। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনা তার। সে কোনদিন ভাবতেই পারেনি যে সত্যি সত্যি এখানে এসে পৌঁছবে। আজ রাত বারোটায় ইলুমিনেশান অর্থাৎ পুরো টাওয়ারটি আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে, তা দেখতে আবার আসতে হবে। তাই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে লিফ্টে করে নেমে আসে তারা। রাতে সবাই মিলে আলোয় আলোকিত আইফেল টাওয়ারকে দেখতে আসে। এবার ঐ শিল্পকর্মটি যেন এক মোহময়ী নারীর মত লাগে। যেখানে তারা দাঁড়িয়ে দেখছিল তার পাশেই ছিল আলোকোজ্জ্বল ল্যুভের মিউজিয়াম। সারা পৃথিবীর আপামর মানুষের ভাল লাগা লাস্যময়ী মোনালিসার অধিষ্ঠান সেখানে। এর এক অমোঘ আকর্ষণ অখিলেশের কাছে। আগামীকাল সকালে তাদের ডিজনিল্যান্ড। পরদিন তার দেখা হবে মোনালিসার সাথে।

ছেলেমেয়েদের আজ উৎসাহের শেষ নেই তারা ডিজনিল্যান্ড দেখবে এই আনন্দে। অখিলেশও কি তার শৈশবকে খুঁজবে ওদের সাথে? এত রকমের rides ও entertainment তার ধারনার বাইরে। সব আনন্দ একসঙ্গে উপভোগ করা কখনো সম্ভব নয়। তার মাঝে এল বৃষ্টি। প্লাস্টিকের বর্ষাতির ব্যবস্থা ছিল তাই অসুবিধা হয় নি। এভাবেই প্যারিসে আরও একটা দিন কেটে যায়। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে তাড়াতাড়ি ডিনার করে সবাই ঘুমোতে চাই। তারা যখন ডিনার সারছিল তখনও সূর্য অস্ত যায়নি (রাত তখন ৯ টার কাছাকাছি)। আগামীকাল ল্যুভর মিউজিয়াম। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও অখিলেশের চোখে ঘুম আসে না। কাল যে তার সত্যি সত্যি দেখা হবে মোনালিসার সাথে। যাকে সে কলেজের সোনা ঝরা দিনগুলিতে পেয়েছিল কাছে নয় দূর থেকে। প্রেসিডেন্সির গেটে সে নামত গাড়ি থেকে। এক অপূর্ব স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য তাকে উজ্জ্বল করে রাখত। ক্লাসে বাংলার চেয়ে ইংরেজীতে বেশী স্বচ্ছন্দ ছিল। অখিলেশ এতটাই সাধারণ মানের ছিল যে তার কাছে যাওয়ার বা দৃষ্টির মধ্যে আসে নি। ক্যান্টিন থেকে লাইব্রেরী কোথাও তার যায়গা হয়নি তার পাশে বসার। কিন্তু একদিন অযাচিতভাবে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় লড়াইয়ে তাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হল। "বাংলা না ইংরেজি" ভাষা লড়াইয়ের আন্দোলন। শুধু ভাষার জন্য তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। প্রবল লড়াইয়ে মোনালিসাকে হার মেনে নিতে হয়। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল হয়ত কেঁদে ফেলবে কিন্তু অখিলেশ যা এতদিন পারেনি আজ তাকে হারিয়ে আপন করে পেতে চায়, দুটো মনের কথা বলতে চায়। হল হাততালিতে ভরে যায়। মোনালিসা খুব কষ্টের সাথে হার স্বীকার করে বেরিয়ে যায়। এর পরেও সে অখিলেশের সাথে কথা বলে না বা তার জয়ের স্বীকৃতি দেয় না। জীবন গড়িয়ে যায়, Part I অনার্সে মোনালিসা ও আরো চারজন ফার্স্টক্লাস পেলেও অখিলেশ পায় না। রেজাল্ট বার হওয়ার পর মোনালিসা যেন অখিলেশকে দয়ার চোখে দেখে। হয়ত পিছনে ফেলার আনন্দে। পার্ট টুতে মোনালিসা অভাবনীয় রেজাল্ট ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়ে সবাইকে চমকে দিল। তখন কলেজের দিন শেষ। রেজাল্ট আনতে গিয়ে অখিলেশ মোনালিসাকে দেখতে পায় সে যেন আজ আনন্দের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। অখিলেশ ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মোনালিসা কাছে ডাকে নিজে থেকেই অখিলেশকে congrats বলে। কিন্তু কেন সে তো 2nd class পেয়েছে আর congrats তো অখিল মোনালিসাকে জানাতে এসেছে। সব কিরকম ওলটপালট হয়ে যায় অখিলের। সবাই চলে গেলে অখিল মোনালিসাকে বলে তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই জানিনা আর কোথাও দেখা হবে কিনা আর মাস্টার্স আমি করব না তাই। আজ মোনালিসা রাজী হয়ে যায়। দুজনে কফি হাউসে বসে কফির অর্ডার দেয়। অখিল বলে "তুমি বোধ হয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার হার আজো মেনে নিতে পারনি"? মোনালিসা মুখ নীচু করে, অখিল বুঝতে পারে তার পুরানো ব্যথাতেই আঘাত করেছে। সাধারণ দুচারটি কথা বার্তার পর অখিল তার ব্যাগ থেকে একটি খাম বের করে দেখিয়ে বলে সংসারের প্রয়োজনে Bankর Probationary Officer হিসাবে আগামীকাল ইন্দোর চলে যাবে, পড়াশুনার আপাতত ইতি জানিয়ে। মোনালিসার মুখটা ফ্যাকাসে দেখায়। কি রকম একটা বিষন্নতা নিয়ে বলে "সময় পেলে চলে এসো Oxford এ দেখা হবে। আমিও আগামী মাসে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।"

বিশ্বের বৃহত্তম মিউজিয়াম ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনে অখিলেশ সপরিবারে দাঁড়িয়ে। ৭২,৭৩৫ বর্গমিটার প্রায় ন'লক্ষ বর্গফুট জায়গা জুড়ে তিন লক্ষ আশি হাজার বস্তু, পঁয়ত্রিশ হাজার শিল্পকর্ম নিয়ে এই অত্যাশ্চর্য মিউজিয়ামটি। যদি একজন মানুষ এক একটির পিছনে ত্রিশ সেকেন্ড দেয় তাহলে তার চার মাস সময় লাগবে কোন রকম বিরতি ছাড়া। সারা পৃথিবী থেকে দশ কোটি পর্যটক আসেন এই যাদুঘরটি দেখতে। তথ্য অনুযায়ী ৮০% মানুষ দেখতে আসেন শুধু "মোনালিসা"কে। অখিলেশ দ্যা ভিঞ্চির এই সেরা শিল্পকর্মটি প্রায় কুড়ি ফুট দূর সুরক্ষা বলয় থেকে দেখে মাত্র ৩০"x২১" বাঁধানো ফটো ফ্রেমে। তার কাছেই সবচেয়ে বেশি ভিড়। মিশরীয়, গ্ৰীক, রোমান, ইসলামিক ভাস্কর্য আলঙ্কারিক, চিত্রকর্ম, ছাপ শিল্প ও অঙ্কন নিয়ে সারা মিউজিয়ামকে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এতো কিছুর মধ্যেও অখিলেশের মনে হয় ল্যুভর মিউজিয়ামটা শুধু মোনালিসার জন্য। কোন কিছুই তার আর মনে ধরে না। সে ভাবে ল্যুভর মিউজিয়ামটাই যদি ভারতে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু এতো অলীক ভাবনা। আসলে সে কি পঁচিশ বছর আগের কলেজ সহপাঠী মোনালিসাকে খুঁজছে?

প্যারিস ছেড়ে জার্মানী, অষ্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস থেকে স্টেনার লাইনের জাহাজে চড়ে তারা পৌঁছাবে লন্ডনে। সেখানে বেশ কয়েক দিন কাটিয়ে তারপর দেশে ফেরা। অখিলেশের মনে হল একবার অক্সফোর্ডে কি খোঁজ করবে মোনালিসা চৌধুরীকে! ফেসবুকে চেষ্টা করেও সে খুঁজে পায় নি। হয়ত মোনালিসারা কোনদিন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না। তা লিওনার্দোর হোক বা কলেজ জীবনের অব্যক্ত প্রেমিকাই হোক তারা এই ধরায় রবে চির অধরা।