আলো চলে গেল। আমাদের গ্রুপের আরও অনেকে চলে গেল। কেউ পড়াশোনায় ক্ষান্ত দিল, কেউ বাবার ব্যবসা সামলানোর কাজে মন দিল, কেউ অন্যত্র ভর্তি হলো। কেবল আমি একা রয়ে গেলাম সরকারি মহাবিদ্যালয়ে আমার শৈশবের দিদি ভাইয়ের গল্প সবাইকে শোনাবো বলে। একে একে আমরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে শুরু করলাম। পুরনো চিত্রটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো। কলেজের সীমানা জুড়ে নতুন নতুন চারাগাছ লাগানো হলো। তারা ক্রমশ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে লাগলো, কলেজ অঙ্গন নতুন নতুন পাখপাখালির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রকৃতির রূপ ক্রমশ পরিবর্তিত হতে হতে এক নতুন রূপে ধরা দিতে লাগলো। বাগানের ফুলগুলো নতুন নতুন রঙে সেজে উঠলো, কলেজের রোয়াক কিংবা সিঁড়ির ধাপে আর কাউকে বসতে দেখা গেল না, করিডোর দিয়ে কেবল অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের পদধ্বনি শোনা যায়। নতুন অধ্যক্ষ মহাশয় এলেন, তিনি তাঁর দায়িত্ব বুঝে নিলেন। এবার ওপরওয়ালার নির্দেশ এলো - কলেজ থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ তুলে দিতে হবে। কেবলমাত্র পাশ ও অনার্স কোর্স চালু থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ও হস্তান্তর হবে, এতদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিলো কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়, এবার থেকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম চলবে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা তদন্ত কমিটি এসে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। কলেজের এক শ্রেণীর কর্মী এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করলেন। শুরু হলো আলোচনা পর্ব, এটা এবার চলতে থাকবে। এই হস্তান্তরের ফলে কী সুবিধা আর কী অসুবিধা তা আমরা বুঝতে পারলাম না। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা ফারাক তো নিশ্চয় আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো আর ঐতিহ্যবাহী, অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়। তার সাথে নিজের নামটা জড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি আছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সেই আবেগ বা অনুভূতি আছে কীনা তা সময়ই বলবে। যাইহোক আমাদের এই বিতর্ক নিয়ে কাজ নেই। ঠিকমতো পড়াশোনা চললেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবো। ওসব বড়ো বড়ো মানুষের বড়ো বড়ো মস্তিষ্কের মধ্যে আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রবেশ না করানোই ভালো। আলোর সাথে পরে একদিন দেখা হয়েছিল, এখন ওরা অনেকটা ভালো আছে। ওর ভাই মন দিয়ে পড়াশোনা করে, বাড়ির অনেক কাজে সাহায্য করে, মায়ের শরীরটাও আগের থেকে অনেক ভালো। আলোর আলোকিত জীবনের কথা শুনে বেশ ভালো লেগেছিলো, চোখের সামনে একটা অভাবের সংসার একটু সুখের সন্ধান পেয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছে - এটাই একটা বড়ো সংবাদ।
জীবেশ তার বাবার ব্যবসা সামলানোর কাজে মন দিয়েছে। কলেজে পড়তে পড়তে রমার সাথে আলাপ হয় জীবেশের। আলাপ থেকে প্রেম আর তার পরিণতি বিয়েতে গিয়ে পৌঁছায়। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, হঠাৎ একদিন আমার বাসায় এসে উপস্থিত, বলে কীনা - শোন জয়, সামনের মাসের দশ তারিখ আমার বিয়ে তুই কিন্তু অবশ্যই থাকবি। আর হ্যাঁ, বাবা বলেছেন বিয়ের তিনদিন আগেই আমাদের বাড়িতে এসে থাকবি, তোর ওপর বাবা অনেক বড়ো দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন। বিয়ে, বৌভাত সেরে তারপর তোর ছুটি। আমি কিছু জানিনা এটা বাবার নির্দেশ, আর তুই জানিস আমার চেয়ে বাবা তোকে বেশি ভরসা করেন। শুধু তাই নয় রমাও বলেছে তোকে না দেখলে ও আমার গলায় মালা পরাবে না। এবার বল আমি কী করতে পারি?
আমি তো জীবেশের কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। বলে কি? কাকু আমাকে স্নেহ করেন আমি জানি। কিন্তু এতটা ভরসা করেন তা জানতাম না। ওনার নির্দেশ পালন না করলে ওনাকে অপমান করা হবে, ওদিকে রমা আবার... না, আমি আর ভাবতে পারছি না। মনে নানারকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে একদিন কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাকু তো আমাকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন - আয় বাবা, আয়। আমি জানতাম, তুই আসবি, এই অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষের কথা তুই ফেলতে পারবি না। আয়, আয় একটা তালিকা তৈরি করে ফেলি, প্রথমে অতিথি-অভ্যাগতদের তালিকা, তারপর বিয়ের প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর তালিকা, পুরুতঠাকুরকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি উনিও এসে পড়বেন, আসলে সময় তো আর বেশি নেই। তাছাড়া তুই তো জানিস তোর কাকিমা চলে যাবার পর আমিও অনেকটা একা হয়ে পড়েছি। আর আমার এতবড় একটা ব্যবসা আমি একা সামলাতে পারছি না। জীবেশ তাও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডিটা পেরিয়েছে কিন্তু ওর ছোটো ভাই তো ক্লাস এইটও পাশ করতে পারলো না। ওকে আগেই দোকানের কাজে লাগিয়ে দিয়েছি, কিন্তু ওর মনটা বড়ো চঞ্চল। ওর দ্বারা এ ব্যবসা সামলানো মুশকিল, কিন্তু ব্যবসার কাজে জীবেশ আমার হীরের টুকরো। তাই সকাল সকাল ওর বিয়ে দিয়ে ওকে সংসার এবং ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
কাকুর কথা শুনে আমার মনটাও আর্দ্র হয়ে উঠলো। কত ব্যথা জমে আছে ওনার বুকে। আমাদের কথোপকথনের মাঝে পুরুতঠাকুর এবং জীবেশ একসাথে এসে পড়লো। জীবেশ ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো - ভাই, তুই এসেছিস, ওহ্, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে... দাঁড়া, রমাকে জানিয়ে দিই।
- এই দাঁড়া, শোন। আমি এমনি এসেছি, পরশু আসবো।
- ঠিক?
- হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ।
- আরে সেই কথাটাই রমাকে বলি। ও তো বারবার বলেই যাচ্ছে। ওকে একটু শান্ত তো করি।
- ঠিক আছে। যা ভালো বুঝিস কর। আসলে রমার সাথে একটু গল্প করবি এটা পরিষ্কার করে বল এত বাহানা করার কী দরকার ছিল।
আমার কথা শুনে জীবেশ হো হো করে হেসে উঠলো। সত্যি বলতে কী এত খুশি হতে জীবেশকে আমি খুব কম দেখেছি। রমার সাথে জীবেশের একটা অপূর্ব মেলবন্ধন ছিলো। দু’জন দু’জনের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল, আমি জানতাম ওদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। ওরা আমার সাথে সবকিছুই শেয়ার করতো, আমি যে ওদের একমাত্র বিশ্বাসী বন্ধু সেকথা ওদের আচার-আচরণে ফুটে উঠতো। আমি ছাড়া ওদের এই অন্তহীন প্রেমের কথা আরও দু’জন জানতেন - একজন হলেন জীবেশের বাবা আর দ্বিতীয় জন জীবেশের মামা। জীবেশ অবশ্য শৈশব থেকেই ওর বাবাকে না জানিয়ে কিছু করতো না। জীবেশের মনটা ভীষণ ভালো, অন্তত আমি যতটা ওকে চিনি তা থেকে বলতে পারি এমন দয়ালু আর নরম মনের মানুষ আজকের যুগে সত্যি বিরল। একটা দিনের কথা বেশ মনে পড়ে... আমরা তখন সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলেজের পূর্ব দিকের মাঠে বসে আছি, নানারকমের হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজব করছি এমন সময় রুক্ষ শুষ্ক চুল একমুখ দাড়িগোঁফ নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। হাতে একটা প্রেসক্রিপশন এবং ময়লা একটা ফাইল, কী ব্যাপার, জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল ওর একমাত্র মেয়ে রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। মেয়েটির বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, বেশ কয়েক বছর আগে মেয়েটির মা গত হয়েছেন। মাতৃহারা ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়েটি ভদ্রলোকের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। স্ত্রী গত হবার পর তিনি কেমন উদভ্রান্তের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন, মেয়েটির পরম পিতৃভক্তির কাছে তিনি হার স্বীকার করে বাড়ি ফিরে স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করেন। স্থানীয় এস টি এম কারখানায় তিনি কাজ করতেন, হঠাৎ করে একদিন কারখানা লকআউট হয়ে যায়। কোম্পানির লাভ হচ্ছে না এই অজুহাতে রাতারাতি প্রচুর শ্রমিক কর্মচ্যুত হন। ভদ্রলোকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এর মধ্যে লক্ষ্য করেন যে তাঁর একমাত্র সন্তান চিনু (আদরের ডাকনাম) মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। ডাক্তারবাবু নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান যে চিনু ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই রোগ সারানোর একমাত্র উপায় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। তার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। আমরা সবাই একমনে তার কথা শুনছি। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে যে একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমাদের দেশে এই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া ততটা উন্নত নয়, বিদেশে বিশেষত আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে হতে পারে। একজন কর্মচ্যুত শ্রমিকের পক্ষে এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এটা ভদ্রলোক বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু অপত্য স্নেহ এমনই যে, কোনো যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। তিনি মনে করেন এখনো দেশে ভালো মানুষের দল শেষ হয়ে যায়নি। তাঁদের নিকট গিয়ে হাত পেতে দাঁড়ালে নিশ্চয় কিছু না কিছু সাহায্য পাবেন। সেই ভরসা বুকে নিয়ে তিনি অর্থের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন। ভদ্রলোক আমাদের সামনে তাঁর কাগজপত্রের বোঝা মেলে ধরলেন। জীবেশ বললো - কাকু এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট।
জীবেশ ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরলো এবং কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো - চিনু আপনার মেয়ে নয়, ও আমার বোন। আমি ওর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করে দেব, আপনি আগামী সপ্তাহে একবার আসুন। না, আগামী বুধবারে আসুন। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে রাখবো।
সত্যি বলতে কী আমাদের কারও ধারণা ছিলো না যে জীবেশ ঠিক কত টাকার জোগাড় করতে পারবে। আমরা সবাই কিছু কিছু করে টাকা তুললাম। সব এক জায়গায় করে দেখা গেল শ’দুয়েক টাকার জোগাড় হয়েছে। এই ক'টা টাকায় কী হবে। এ তো ওই রোগের জন্য ব্যবহৃত একটা ক্যাপসুল বা ইঞ্জেকশনের দামও নয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন তো দূর-অস্ত। টাকা ক’টা হাতে নিয়ে আমাদের চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। মনে মনে একবার নিজেকে আর একবার এই পচাগলা সমাজব্যবস্থাকে ধিক্কার জানাতে লাগলাম। চিনুর কথা মনে করে প্রায় সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। দেখতে দেখতে বুধবার এসে গেল। এর মধ্যে অনেকবার জীবেশের সঙ্গে কথা বলেছি। ও কিন্তু কেবল নীরব হাসি ছাড়া আর কোনো কথা বলেনি। আমরা সবাই একসাথে কলেজ মাঠের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আছি। কারও মুখে কোনো কথা নেই, জীবেশ একগাল হাসি দিয়ে বললো - আমি যখন বলেছি তখন ব্যবস্থা একটা করবোই, তোরা শুধু শুধু মুখভার করে গম্ভীরভাবে বসে আছিস কেন?
নির্দিষ্ট সময়ই ভদ্রলোক এলেন। এবারে তাঁকে বড্ড বিমর্ষ এবং ছেঁড়াখোড়া একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম, খারাপ কিছু ঘটেনি তো? আর পরস্পর পরস্পরের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ভদ্রলোক এসেই জীবেশকে জড়িয়ে ধরে একজন শিশুর মতো কেঁদে বললেন - না বাবা, তোমার বোন চিনুকে বাঁচাতে পারলাম না। তোমার সমস্ত প্রচেষ্টা বিফলে গেল।
- তার মানে?
আমরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম।
- না বাবা সকল গত পরশু রাতে চিনু আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
এই নাও বাবা জীবেশ, তোমার বাকি টাকাটা। দেহ সৎকার করতে কিছু ব্যয় হয়েছে, কিছু ওষুধের জন্য খরচ হয়েছে। আর...
- চুপ করো কাকা, তুমি চুপ করো। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
সেদিন আমরা সবাই মিলে জীবেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারছিলাম না।
টাকা ক’টা জীবেশের সামনে রেখে ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন। জীবেশ কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো - দাঁড়াও পাচুকাকা, আমাদের ছেড়ে কোথায় যাচ্ছো? এদিকে এসো।
- না বাবা আমাকে আর ধরে রেখোনা। আমাকে যেতে দাও।
- কোথায় যাবে তুমি?
- কোথায় আর যাবো? তিনকুলে তো আমার আর কেউ রইলো না। এবার দেশান্তরী হবো।
টাকা ক’টা তুলে নিয়ে জীবেশ পাচুকাকার হাতে দিয়ে বললো - অত কথা বললে শুনবো না। তাকিয়ে দেখ এতগুলো ছেলে-মেয়ে তোমার মুখের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। এদের কে ছেড়ে তুমি চলে যাবে? আমরা বুঝি তোমার কেউ নই? নাও নাও, টাকা ক'টা নাও, বাড়ি গিয়ে বোনের বাকি কাজকর্ম করো, তারপর একদিন আমার সাথে দেখা কোরো।
(ক্রমশ)