গল্প ও অণুগল্প

আকাশটা এখনও নীল



অচিন্ত্য সাহা


সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেল নীলার। আজ একটু আগে অফিসে পৌছনোর কথা। গতকাল বারবার করে বলে দিয়েছিলেন বড়বাবু।

- নীলা আগামীকাল একটু আগে মানে আটটার মধ্যে অফিসে চলে এসো কিন্তু, কাজের একটু চাপ আছে।

- ঠিক আছে বড়বাবু, আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে আসব।

কিন্তু সেটা আর হলো কই, মেয়েটা ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি করে ফেলল। সাড়ে সাতটার মধ্যে স্কুলে না পৌঁছতে পারলে, গেট বন্ধ করে দেয়, স্কুলে ঢুকতে দেয় না। তড়িঘড়ি ওকে তৈরি করে যখন স্কুলের গেটে এসে পৌঁছলো তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই। ফলে যা হবার তাই হলো। তৃষাকে ওরা স্কুলে ঢুকতে দিলেন না। নীলা অনেকবার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। তৃষাকে সেই মুহূর্তে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো সময় ছিল না। অগত্যা স্কুলের সন্নিকটে নীলার একজন প্রিয় বান্ধবী থাকে তার কাছেই নীলা ওর একমাত্র অবলম্বন তৃষাকে রেখে দ্রুতপায়ে অফিসে পৌঁছে গেল। এতকিছুর পরও সে মাত্র দশ মিনিট দেরী করে অফিসে আসার ফলে বস বেশ অসন্তুষ্ট হলেন। নীলা কী আর করবে। ইচ্ছে করে তো আর দেরী করে আসেনি, পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছে। কতবার করে মেয়েটাকে পইপই করে বলা হয়, কিন্তু কে কার কথা শোনে। বাবা-মায়ের কথা না শুনলে তাদের ভবিষ্যতে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে - এটা আজ-কালের ছেলে-মেয়েরা বুঝতে চায় না।

বড়বাবু বললেন - চলো, একটু আউটিং-এ যেতে হবে।

নীলা ঠিক বুঝতে পারল না।

- মানে?

- আরে চলোই না। যেতে যেতে সব বলছি।

- তবে যে বললেন অফিসে কাজের চাপ আছে।

- হ্যাঁ। অফিসের কাজেই তো যাবো।

নীলা কী করবে বা ঠিক কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারল না। নীরবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বড়বাবু ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন - ভয় নেই মা, আমি তো তোর সঙ্গে আছি।

নীলা খানিকটা চমকে উঠল। বড়বাবু হঠাৎ 'তুমি' থেকে 'তুই' সম্বোধন করে বসলেন। ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই আর এক বিস্ময়! ড্রাইভার রথীনকে ডেকে গাড়িটা বার করতে বললেন। নীলা কিছু বলার আগেই বড়বাবু হঠাৎ ওর হাত ধরে বললেন - আর দেরি করিস না মা, তাড়াতাড়ি চল।

নীলা খানিকটা যন্ত্রচালিতের মতো বড়বাবুর পিছু নিল। নানারকম আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করল ওর মনে। আসলে ওর মাত্র বত্রিশ বছরের জীবনে যেসব মানুষকে দেখেছে তার মধ্যে বেশিরভাগই ওর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ওকে বিপদে ফেলতে চেয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন ভালো মানুষও ওর জীবনে এসেছে। তারা ওকে আজকের নীলা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

একটা পথ দুর্ঘটনায় ওর বাবা মারা যান। তখন কৃষ্ণনগর হোলি ফ্যামিলি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল নীলা। বাবা ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে মোড় ঘুরে ডি আই অফিসে যাওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটা দশ চাকার লরির ধাক্কায় প্রাণ হারান। নীলার পিতার মৃত্যুতে ওর মা ভীষণ ভেঙে পড়েন। মাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা ওর কাছে ছিল না। সেদিন নীলার অনুরোধেই বাবা নতুন স্কুটি করে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। তাই পিতার মৃত্যুর জন্য ও নিজেকে কিছুটা দায়ী মনে করে। নীলার গৃহশিক্ষক সুব্রতবাবুর নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে মা ডি আই অফিসে একটা ক্লার্কের চাকরি পান। নীলার মন খানিকটা শান্ত হয়। কিন্তু ও লক্ষ্য করে মায়ের ভেতরটা দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো ওর কাছে আসে না, কথা কম বলে, আপন মনে বিড়বিড় করে কীসব বলে! জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক জবাব দেয় না, কথাবার্তা কেমন যেন অসংলগ্ন। ইতিমধ্যে নীলা সোশিওলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী কমপ্লিট করে। মায়ের শরীরটা দিনদিন আরও খারাপ হতে থাকে।

একদিন সুব্রতবাবু মায়ের কাছে আসেন। নীলা তখন কলকাতায় ওর এক বন্ধুর সাথে চাকরির ব্যাপারে কথা বলার জন্য বেরোচ্ছিল। মায়ের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওঁদের অস্পষ্ট কথাবার্তা নীলার কানে আসে। তাতে বুঝতে পারে মা অর্পিতাদেবী অন্ত্রের এক কঠিন রোগে আক্রান্ত। এখানে মানে পশ্চিমবঙ্গে তার সঠিক চিকিৎসা নেই। হায়দ্রাবাদ অথবা ভেলোর যেতে হবে। চিকিৎসার খরচ বহন করার মতো আর্থিক অবস্থা ওদের নেই। তাই মায়ের ধারণা হয়তো বিনা চিকিৎসায় অকালে তাঁকে চলে যেতে হবে। তিনি চলে যান তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু মেয়েটা বড়ো একা হয়ে যাবে - এই চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

কথাটা শুনে নীলার মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। মায়ের এতবড় একটা কঠিন অসুখ অথচ মা তাকে কিছুই বলেন না! ওর একটু অভিমানও হয়। মা তাকে এতটুকু ভরসা করতে পারেন না?

সেদিন নীলার কলকাতা যাওয়া হয়নি। পরে বন্ধু অর্ণবকে চিঠি লিখে সবকিছু জানিয়েছিল। সুব্রতবাবু চলে যাবার পর নীলা অর্পিতা দেবীর ঘরে ঢুকে মা-কে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। "মা তুমি আমাকে এতদিন কিছু বলোনি কেন? আমি কী তোমার কেউ নই? জানি, বাবার অসময়ে চলে যাবার জন্য আমিই দায়ী। তাই বলে আমাকে..." অর্পিতা দেবী নীলার মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেন - "না রে মা, ঠিক তা নয়। তোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমি তোকে বিরক্ত করতে চাইনি"।

পরদিন আবারও সুব্রতবাবু এলেন। তিনি সরাসরি মা'কে বললেন - "বৌদি, আমার একমাত্র ছেলে সত্যমকে তো আপনি চেনেন। ও ভুবনেশ্বর থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে গ্রাজুয়েশন করে বর্তমানে কলকাতায় টিসিএস-এ কর্মরত। আমার ছেলে বলে বলছি না। ও অন্যান্য ছেলেদের মতো নয়। আপনি নির্দ্বিধায় সত্যমের সাথে নীলার বিয়ে দিতে পারেন"।

অর্পিতা দেবী যেন পরম স্বস্তি পেলেন। তিনি দ্বিরুক্তি না করে রাজি হয়ে যান। নীলার বিয়ের এক বছরের মধ্যে ওর কোল আলো করে ওদের জীবনে আসে ওর মেয়ে তৃষা। ফুটফুটে শিশুটির মুখ দেখে অর্পিতা দেবী পরম তৃপ্তির সাথে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।

নীলা তখন কলকাতায়। কিছুদিন পর শ্বশুরমশাই সুব্রতবাবু একদিন গভীর রাতে ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যান। পরপর তিন বছরের মধ্যে সত্যম কার অ্যাকসিডেন্টে, শ্বাশুড়ি মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নীলার আপনজন বলতে আর কেউই বাকি রইল না।

গাড়ির পিছনের সিটে বসে ওর বিগত জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে নীলা ভুলেই গিয়েছিল যে ও কোথায় চলেছে। হঠাৎ ওর ব্যাগে রাখা স্মার্ট ফোনটা বেজে ওঠে। তড়িঘড়ি ফোনটা বার করে দেখে প্রীতির ফোন। ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে প্রীতির কণ্ঠ - "হ্যালো নীলা। তৃষা দুপুরে কী খাবে? তুই তো ওকে রেখে তুফান মেলের মতো ছুটে চলে গেলি। এখানে ওর কোনো জামাকাপড় নেই"।

- এ মা সত্যি তো। বিরাট ভুল হয়ে গেছে।

- না না ভুলের কিছু হয়নি। আমার ছেলের ছোটোবেলার পোশাক ওকে পরিয়ে দিয়েছি। বেশ মানিয়েছে কিন্তু। তুই এলে দেখতে পাবি। সে যাক, কী খাওয়াবো বল?

- না খাবার ব্যাপারে ওর কোনো সমস্যা নেই। যা দিবি তাই ও পরম তৃপ্তির সাথে খেয়ে নেবে। তোরা যা খাবি ওকেও তাই দিস।

- আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি তাহলে।

ফোনটা ছেড়ে দেয় প্রীতি। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নীলা দেখতে পায় প্রায় এগারোটা বাজে। তার মানে প্রায় দু'ঘন্টা ধরে গাড়িটা চলছে। এতক্ষণ সে কিছুই টের পায়নি।

- নেমে এসো মামনি। আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।

নীলা গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা চমকে যায়। বাড়িটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে। মনে হয় পূর্বে এবাড়িতে সে এসেছে। বাড়ির গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে সে আরও অবাক হয়ে গেল। এ যে তার শৈশবের সেই মাসিমনি অনুরূপা দেবী। গাড়ি থেকে নেমে একছুটে সে চলে গেল মাসিমনির কাছে। মাসিমনিকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল নীলা - "মাসিমনি এতদিন কোথায় ছিলে? আমার জীবনে কত সব ঘটনা ঘটে গেছে আর তুমি..."

- আমি সব জানি মা। কিন্তু তোদের সামনে যাওয়ার সাহস আমার হয়নি। তুই হয়তো জানিস না সাধারণভাবে আমার বিয়ে হয়নি। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে ওই মানুষটার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম। সেই অপরাধে - না থাক সেসব কথা। চল ঘরে চল, সেই কতটুকু দেখেছি তোকে। তুই যে আমায় একবারেই চিনতে পেরেছিস - এটা আমার বেশ লাগছে। আসলে রক্তের টান বুঝলি, রক্তের টান।

নীলা জানতে চায় - "ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে তাতে কী"?

- কিছুই না। কেবল উঁচু-নীচু ভেদ। ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছি - এটা কী কম অপরাধ?

এতক্ষণে ব্যাপারটা নীলার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রায় বছর তিনেক একই অফিসে কাজ করে অথচ ও জানেই না যে বড়বাবু একজন মুসলমান এবং আরও আশ্চর্যজনক হল উনি নীলার মেসোমশাই! প্রায় বছর কুড়ি আগে ওঁরা বিয়ে করেছিলেন! সমস্ত জাতি, ধর্ম ও বর্ণের বিভেদ ভুলে গিয়ে এতবড় একটা সাহসী পদক্ষেপ! সত্যি কুর্নিশ জানাতে হয়।

অনুরূপা দেবী পরম মমতায় নীলার হাত ধরে ওকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান। চকমিলানো বিশাল বাড়ি দেখে ও ভীষণ অবাক হয়ে যায়। বাড়িতে মোট সদস্য সংখ্যা বাইশ জন। একান্নবর্তী পরিবার। সবটাই মাসিমনি একা হাতে সামলান। বাড়িতে কোনো পুজো-আচ্চা বা নামাজ রোজার ব্যবস্থা নেই। তবে সব ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে সবাই একসাথে অংশগ্রহণ করেন। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।

ফেরার পথে মেশোমশাই বললেন - "কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল। তুই তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি, তাই না মা"?

- ঠিক তাই।

দুই নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কালো রঙের বিএমডব্লিউ গাড়িটা তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। গাড়ির কাঁচটা খুলে দিল নীলা। একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ওর শরীরটাকে শীতল করে দিল। আকাশের দিকে চোখ মেলে দেখতে পেল মেঘমুক্ত নীল আকাশ ওকে যেন ঈশারায় ডাকছে - নীলা এসো, কাছে এসো। তোমার মধ্যেই তো আমি বেঁচে আছি।

অফিস থেকে ফেরার পথে তৃষাকে নিয়ে নীলা বাড়ি এলো। ওর মনের মধ্যে তখনও অনুরণিত হচ্ছে - "অনেকদিন পর এলি মা। পরে নাতনিকে নিয়ে আসিস। কেউ না থাকলেও আমি তো আছি। বিপদে-আপদে আমার কথা স্মরণে রাখিস মা। আকাশে মেঘ আছে ঠিকই কিন্তু এখানে আকাশ এখনো নীল"।