আষাঢ় মাস। গ্রামের আকাশ জুড়ে আজ সারাদিন ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। সকাল থেকেই মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে চলেছে, বৃষ্টি নামেনি। সাথে হঠাৎ-ই শুরু হয়েছে উন্মত্ত দমকা হাওয়া।
- কই যাও?
- মাঠে যাওয়া লাগবে।
- এই অসময়ে মাঠে যাবা কেন? আকাশের অবস্থা দেখেচ?”
- হারুন সাহেব লোক পাঠাইছে। নালা নাকি রাতির বৃষ্টিতে পানি-ভত্তি হই গিছে। পানি ছাড়াই কাদা তুইলি দি আসি গে। না হলি আইজ ফের পানি বাধলি সমস্যা হবেনে।
- তা তোমার যে জ্বর। গাডা তো জ্বরে পুইড়ি যাচ্ছে। আমি তো মাথা ধুয়ার পানি আনতিই বের হলাম, এর মদ্দিই নাইমি পড়িচ?
- জ্বর বইলি বইসি থাকলি তো আর প্যাট চলবে নানে। ছেইলি-মেইয়িগুলা না খায়ি আর কদ্দিন থাকপে! অভাবের সংসার! শরীলির দিকি তাকায়ি বইসি থাকলি তো আর হয় না।
কথা শেষ করে কোদাল কাঁধে নিয়ে রতন বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে চলতে শুরু করল।
এক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মাঠে পৌঁছাতে হয় তাকে। তার উপর বৃষ্টি হলে এক মাইলের পথ দুই মাইলে পরিণত হয়। ধুলো-মাটিতে ভরা বঞ্চিত গ্রামগুলো একটু পানি পেলেই পদগ্রাসী হয়ে ওঠে। কর্দমাক্ত পথচলা শেষ হলে রতন দেখে ক্ষেতের নালা কাদা-পানি ভর্তি হয়ে উপচানো পানি সম্পূর্ণ ক্ষেতটাকেই ভাসিয়ে দিয়েছে। রতন আকাশের অবস্থাটা একবার দেখে নিয়ে কোদাল দিয়ে নালার কাদা ছাড়াতে লেগে গেল।। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামল বেশ জোরে। অসুস্থ রতন কাঁপতে কাঁপতে অনেকক্ষণের প্রচেষ্টার পর নালার কাদা সরিয়ে ফেলল। কিন্তু বৃষ্টি আবার নতুন করে নালা ভরতে লাগল।
- ও আল্লাহ্ কি করি! কাল তো এই শরিল নিয়ি আসতি পাইরবো বুইলি মনে হচ্চে না। একটা কাজ করি, নালাডা আরও এট্টু গভীর কইরি দিই। দুই-এক জায়গায় এট্টু বড় কইরি গত্ত বানাই দি।
রতন কম্পমান হাতজোড়া দৃঢ় করার প্রচেষ্টায় শক্তভাবে কোদালটা চেপে ধরে ক্রমাগত নরম মাটিতে আঘাত করতে থাকে।
- আল্লাহ্! হাতের কাপাকাপি যে বন্দ কত্তি পারছি না। শরীলডাও শীতি কাপছে। আহারে শরীল! আর এট্টু কষ্ট কর। দুইডা কইরিই চইলি যাব। আর ভাল্লাগে না।
তৃতীয় গর্ত দেড় হাত মতো খোঁড়ার পরে হঠাৎ কোদালটা আটকে গেল। কোদালটা ছেড়ে দিয়ে রতন পাশেই বসে পড়ল। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানি দু’হাতে নিয়ে তার হিমশীতল মুখে ঝাপটা দিল, গলায় মাখাল। সামান্য কিছুক্ষণের জন্য সে চোখ দুটো বন্ধ করে জিরিয়ে নিল। তারপর কম্পমান শরীরটিকে অতি কষ্টে দাঁড় করিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে হাত দুটোকে মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। কোদাল তুলে আবার গর্তে আঘাত করল। কিন্তু কোদালটি কিছুতে বেঁধে টং শব্দ করে আটকে গেল। রতন এবার কোদালটা আস্তে করে টেনে বুঝতে চেষ্টা করলে সে কিছু একটা ধাতবের উপস্থিতি অনুভব করল যেন।
অনিশ্চিত সৌভাগ্যের ভীতিময় কল্পনা রতনের দেহ ও মনে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করল, সে গর্তের খুব কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে মাটি সরাতে লাগল আর প্রতিবার কোপের পরে হাত দিয়ে দেখতে লাগল। কোদাল দিয়ে, হাত দিয়ে পাগলের মতো মাটি আলগা করতে লাগল রতন। তার অযাচিত ভয় ধীরে ধীরে তীব্র চাপা আনন্দে রূপ নিতে থাকল। অল্প সময় পরেই একটি পিতলের কলসের মুখ বেরিয়ে এল। রতন বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে হা-মুখে কলসের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর এক ঝাটকায় উঠে সে চারপাশটা বিদ্যুতের আলোয় সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে পুনরায় কলসের চারপাশ মাটি মুক্ত করা শুরু করল। কলসের গায়ে লাগা কোদালের আঘাতের ঝনঝন শব্দ আর ঝরঝর ঝরে পড়া বৃষ্টির অবিরাম শব্দ প্রগাঢ় অন্ধকারের বুক বিদীর্ণ করে জনশূণ্য মাঠের চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নির্জন নিস্তব্ধতা সত্বেও নিরীহ কৃষকটির মনে সর্বদা লোকপস্থিতির আশঙ্কা বিরাজ করছিল। ফলে সে ক্ষণিক পরপরই চারপাশ দেখে নিতে লাগল বিদ্যুৎ চমকের আলোতে। অবশেষে কলসটি মৃৎ-বন্ধন মুক্ত হয়ে উঠে এল।
রতন চারপাশটা একনজর ভালো করে দেখে নিয়ে কলসটি তুলে নিতে গর্তে ঝুঁকল। আনন্দাশ্রু তার দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে বৃষ্টির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে কলসের গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে লাগল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে কলসটিকে বুকে জড়িয়ে নিল।
- আহ! আমার আইজ দিন আইলো গো, আমার দিন আইলো। এতকাল পরে আমার দুখের দিন শ্যাষ হইলো। আমি আর লোকের ক্ষ্যাতে কাজ কইরবো না। আমার, আমার বউ-বাচ্চাগের আর না খাইয়ি থাকতি হবে না। আমার কপালেও এত্ত সুখ ছিইলো!
তার কান্না অন্ধকারের স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে দিয়ে মাঠ জুড়ে প্রতিধ্বনির শত কণ্ঠ বহন করছিল। হঠাৎ শত কামানের একটি তীব্র গগণবিদারী গর্জনে তার কণ্ঠ নীরব হয়ে গেল। সন্ধ্যা পুনরায় স্তব্ধ হল। ঝরঝর বৃষ্টির ঝরে পড়ার শব্দ সব শব্দকে আড়ালে ঢেকে দিল। শুধুমাত্র ছোট্ট একটি শব্দ, কলসের গড়িয়ে গর্তের পানি-কাদায় পড়ার শব্দ, যা কেবল পরম শ্রোতাই শুনলেন।