ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

ভূটানঃ বজ্র ড্রাগনের দেশে



কাকলী দেব


ভূটানের আর এক নাম, 'ল্যান্ড অফ দ্য থান্ডার ড্রাগন'। যেখানে সবসময়ই কিছু না কিছু উৎসব লেগেই আছে। কান পাতলে শোনা যাবে, বাঁশি বা ট্র্যাম্পেটের আওয়াজ। চারিদিকে পাহাড়ের আড়াল, তাই প্রকৃতিগতভাবে খুব সুরক্ষিত একটা দেশ।

আবার সেই বাগডোগরা ফ্লাইট। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এক জার্নি এত সুন্দর, উঠতে না উঠতেই নামার সময় হয়ে যায়। একইভাবে দার্জিলিঙও ঘুরে গেছি। এবার বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রুটটা একটু আলাদা হল। গাড়ী সেবক ব্রিজ পেরিয়ে এসে মালবাজারের রাস্তা ধরল। আগেরবার আমরা কালিম্পঙের রাস্তা ধরেছিলাম। মালবাজারে এসে এক জায়গায় গাড়ী দাঁড়াল। একটু চা জলখাবার খাওয়া হল। দার্জিলিঙের পরে একবার বাসে করে আমরা বন্ধুদের সঙ্গে জলদাপাড়া ঘুরতে এসেছিলাম। তখন যে 'সুমারু রিসর্ট'-এ ছিলাম এবার আবার সেখানেই উঠব এক রাতের জন্য। সুমারু'র মালিক অর্ণব এবার আমাদের ভূটান ট্রিপ ঠিক করে দিয়েছে। ট্যুর অপারেটর হিসেবেও কাজ শুরু করছে এ কথা জানামাত্রই একজন তো লাফিয়ে উঠল আর তখনই সব ফাইনাল হয়ে গেল যে, এবার আমরা ভূটান যাব।

'সুমারু রিসর্ট'-এর কথা আর কি বলব, একদম নিজের বাড়ীর মতো। সুমারুতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে ছ’টা বাজল। দেরী হল কারণ জলদাপাড়ায় গিয়ে সুমারু'র রাস্তা গুলিয়ে গিয়েছিল। যাই হোক আমরা দু'বার করে এলাম বলে আমাদের খাতির হল খুব।

সুমারু তেমন আহামরি না হলেও কেন জানিনা এখানকার পরিবেশ, ওদের ঘরোয়া ব্যাপারটা খুব ভাল লাগে। ফাইভ স্টার ফেসিলিটির রিসর্ট হয়ত এখানে এখন পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা সুমারু হবে না। পরদিন সকালবেলা অন্য গাড়ী এল, এই ড্রাইভার আমাদের ফুন্টশোলিং ছেড়ে আসবে।

ভূটানের বর্ডার শহর ফুন্টশোলিং, এপারে ভারতের জয়গাঁও। বেশ নোঙরা, ঘিঞ্জি, আধা মফস্বল শহর এই জয়গাঁও। রকমারি মানুষের ভীড়ে ভরা। আমরা গাড়ী পার্ক করে বসে রইলাম একটা জায়গায়, ভূটান থেকে একজন গাইড আসবে তার হাতে আমাদের হ্যান্ডওভার করে দিলে এই গাড়ীর ড্রাইভারের দায়িত্ব শেষ। অর্ণবই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

কিন্তু ওদিক থেকে কেউ আর আসেনা। এদিকে আমার মিস্টার তাড়াহুড়ো, তড়বড়িতে অস্থির হয়ে উঠছে। ক্রমশ তার পারদ চড়ছে। এসব সময়ে আমি এক শান্ত সমাহিত মূর্তি ধারণ করি। সেই অবস্থানে গাড়ীর মধ্যে বসে আছি। ড্রাইভার আর তড়বড়িবাবু অধীর আগ্রহে গাড়ীর বাইরে পায়চারি করছে।

কিছুক্ষণ পরে তো সেই গাইড এল! দেখতে-শুনতে ভাল, ভূটানের জাতীয় পোশাক 'গো' পরিহিত একজন ছোকরা। সে এসে বেশ ধীরেসুস্থে বলল, রাস্তায় জ্যাম, ইমিগ্রেশনে বিরাট লাইন ইত্যাদির কারণে সে সময়মতো এসে পৌঁছতে পারেনি। একজন যদি তড়বড়ি হয় আর একজন তাহলে নড়বড়ি। মিঃ তড়বড়ির অনেক বকাবকিতেও তার কোনও তাপ উত্তাপ দেখা গেল না। যাক নিশ্চিন্ত হলাম। এদের ঝগড়া হবার সম্ভাবনা নেই।

এরপর লাগেজ টানতে টানতে হেঁটে হেঁটে আমরা ইমিগ্রেশন সেন্টারে গেলাম। এতেও নড়বড়ির কোনও তৎপরতা বা সাহায্যের মনোভাব দেখা গেল না। ওর নামটা অদ্ভুত, 'টিলে'। অবশ্য আমাদের ডাকতে সুবিধা হচ্ছিল। জয়গাঁও যতটা নোংরা, ইমিগ্রেশন সেন্টার পেরিয়ে ভূটানের বর্ডার শহর ফুন্টশোলিং ততটাই পরিস্কার।

ইমিগ্রেশনে যেতে গেলে একটা সরু গলিপথ পেরিয়ে যেতে হয়। আশ্চর্য লাগে যে ভারতের দিকের এই রাস্তা পেরিয়ে আজ বছরের পর বছর লোকে ভূটান যাচ্ছে। কিন্তু কী উদাসীন ভারত সরকার যে একটা পরিস্কার রাস্তা বানাতে পারেনি!

ওখানে গিয়ে টিলে বলল আমাদের ভিসার জন্য ন' হাজার টাকা দিতে হবে এই সেন্টারে। আমার হাজব্যান্ড বলল, "আমরা তো সব টাকা পয়সা দিয়ে দিয়েছি আমাদের ট্যুর অপারেটরকে"। ও তখন ওর এজেন্টকে ফোন করে জানল যে, হ্যাঁ আমাদের সব টাকা দেওয়া আছে। এই চালাকি করাটা যে ওর স্বভাব সেটা আমরা অনেক পরে বুঝেছিলাম। এরকম করে ও হয়তো আগেও কোনও সরল ট্যুরিস্টকে ঠকাতে পেরেছে। তারপর বলল, আমাদের মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স-এর জন্য চারশো টাকা লাগবে। এটা অর্ণব আগেই বলেছিল যে এটা করাও যায় নাও করা যায়। এটা করিয়েই নেওয়া হল। কম টাকার ব্যাপার, করিয়ে নেওয়া যায়, যদি দরকার পড়ে।

যাক, ইমিগ্রেশন সেন্টারের সব ফরমালিটিস সেরে আমরা উল্টো দিকের গেট দিয়ে বেরোলাম ফুন্টশোলিং শহরে। সেখানে একটু দূরে আমাদের গাড়ী দাঁড়িয়েছিল। এরকমই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল অর্ণব। আর এটাই এখন সিস্টেম।

ভূটান একটা ছোট দেশ, যার অর্থনীতির অনেকটাই পর্যটন নির্ভর। কোভিডের আগে ভারতের যে কোনও ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে ভূটান ঘুরে আসতে পারত। কিন্ত ২০২১ সাল থেকে ভূটান সরকার সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এখনকার নিয়ম হল, গাইড, গাড়ী এবং ড্রাইভার ভূটানের হতে হবে। তাতে দেশের বেকার সমস্যাও কিছুটা মিটবে।

যে গাড়ীতে এসে আমরা উঠলাম, তার ড্রাইভার আমাদের নমস্কার জানাল। ওর নাম কেদার। ও এই ফুন্টশোলিং-এর কাছেই থাকে, হিন্দিও বলতে পারে। তবে কাজের সূত্রে থিম্পুতেও থাকতে হয়। ওর চেহারাও একেবারে ঠিক ভূটানীদের মতো নয়। পুরো ট্রিপটায় বুঝেছিলাম ও দারুণ গাড়ী চালায়, খুব ভদ্র একজন মানুষ। টিলে মোটামুটি ভাল ইংরিজী জানে তাই গাইডের কাজ পেয়েছে। এজন্য ওদের ট্রেনিংও হয়। সব দেশেই তাই। ট্রেন্ড বা আনট্রেন্ড দু'রকম গাইডই হয়। তবে টিলের উচ্চারণ ভাল না তাই অনেক সময় কোনও জায়গার ইতিহাস ভূগোল বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। এমনকি ধর্মীয় ব্যাপারগুলো বোঝাতেও ও অপারগ ছিল। বুঝতে পারছিলাম যে ও যা বলছে সেটা একেবারেই মুখস্থ বিদ্যা। গাইড হওয়াটা হয়তো ওর মজবুরী ছিল।

অনেক দেশে দেখেছি যারা গাইডের কাজ করছে তারাই গাড়ীও চালাচ্ছে, দুটো কাজই যদি একজন করতে পারে তাহলে তারও সুবিধা আবার ট্যুরিস্টদের জন্যও ভাল।

যাই হোক এবার আমাদের যাত্রা হল শুরু। ফুন্টশোলিং ভারতের একেবারে গায়ে লাগানো একটি শহর। কিন্তু বাড়ীঘর একদম আলাদা, রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। একটা চেক পোস্ট পেরিয়ে আসতে হল। সেখানে আমাদের কাগজপত্রের বৈধতা পরীক্ষিত হল। টিলে এইসব কাজগুলো করল। সামনের সিটে ওরা দুজন আর পেছনে আমরা। ক্রমশ পাহাড়ী চড়াই পথে চলেছি। পথের দু'পাশে অপূর্ব দৃশ্য, পাহাড়ের সারি আর অরণ্য। চারিদিক সবুজে ঢাকা। আকাশ মেঘলা, পথে মাঝে মাঝেই বৃষ্টিও হচ্ছে।

ঘন্টা দুয়েক এইভাবে যাওয়ার পরে চুখা বলে একটা জায়গায় একটা ধাবা জাতীয় রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ী দাঁড়াল। নাম, 'ডিভাইন মিডওয়ে'। যাওয়া আসার পথের ধারে বলে সবাই এখানে একটু রেস্ট নেয়। খাওয়াদাওয়া সারে। একটা বড় ট্যুরিস্ট বাসে করে কেরালার থেকে অনেক লোকজন এসেছে। তারা নিজেদের ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে এসেছে, তাই রেস্টুরেন্টের সঙ্গে হয়তো আগে থেকেই ব্যবস্থাও করে রেখেছে। দেখলাম ওদের নিজেদের মতো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

এই একটানা পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ী চালাতে গেলে এই ব্রেকগুলো খুব দরকার। কেদার আর টিলে গাড়ী থেকে নেমেই সিগারেট খেতে চলে যায়। হাজব্যান্ডের ফটো তোলার শখ। তাই ক্যামেরার সরঞ্জাম আমাদের সঙ্গেই আসে। সে এখান থেকেই ভূটানের ফটোশুট শুরু করে দিল।

আরও দু' ঘন্টা পথ পেরিয়ে আমরা অবশেষে এলাম রাজধানী থিম্পুতে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয় সুন্দর লাগল থিম্পুকে। চারিদিকের পাহাড়ের মাঝখানে এক বিশাল উপত্যকা জুড়ে শহরটা। পাহাড়ের গায়ে গায়েও তা ছড়ানো।

কোপেনহেগেনে ২০০৯ সালে ইউনাইটেড নেশনস্-এর ১৫ নম্বর অধিবেশনে ভূটান শপথ নিয়েছিল যে, নিজের দেশকে কার্বন মুক্ত রাখবে। কিন্তু তা স্বত্বেও আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষনীয় হয়ে উঠেছে। হিমালয়ের কোলে এই দেশটি প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী। প্রায় সত্তর শতাংশ জমিতে শুধু অরণ্য। ভূটান পর্যটনকারীরা, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখতেই আসে।

Gross National Happiness (GNH)-এর দেশ বলে দেশটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মহিলাদের ওপর অত্যাচার আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে।

আমাদের ভারতীয় টাকা এখানে অবাধেই ব্যবহার করা যায়। ভূটানী গুলট্রাম আর টাকার ভ্যালুয়েশন একই। এখানে ক্যাশ টাকাই চলে, কোনও পেটিএম বা গুগ্ল পে জাতীয় ইউপিআই ট্রানজাকশন হয় না। চট করে এটিএম মেশিনও চোখে পড়বে না, সুতরাং ভূটান যেতে গেলে ক্যাশ টাকাই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

আমরা এসে উঠলাম লেমন ট্রি হোটেলে, শহরের একেবারে মাঝখানে হোটেলটি, আশেপাশে আরও অনেক নামীদামী হোটেল। ভাল রুম পাওয়া গেল, জানলা দিয়ে দূরে সবুজ পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। হোটেলের লবিতে প্রথমেই আমাদের একরকম চা পরিবেশন করা হল যেটা দারচিনির গুঁড়ো আর মধু দিয়ে তৈরী, ঠান্ডার জন্য বেশ ভাল। এখানকার স্টাফ, ব্যবস্থা, খাওয়াদাওয়া সবই বেশ ভাল। আমরা ভাবলাম শহরে হোটেলের কাছাকাছি এলাকায় একটু হেঁটে ঘুরে আসি। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। টিলে আমাদের নামিয়ে ওর আস্তানায় চলে গেছে।

তখন চলছে থিম্পু সেচু ফেস্টিভ্যাল। গুরু পদ্মসম্ভবকে স্মরণ করতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাধারণ ভূটানী জনগণ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। পুরুষেরা নতুন 'গো' পরে আর নারীরা পরে 'কিরা'। চার পাঁচদিন ধরে চলে এই উৎসব। বৌদ্ধ লামারা অনেকে নানারকম মুখোশ পরে নাচ গান করে। থিম্পু সেচু উৎসব হয় শরৎকালে আর পারো'তে সেচু উৎসব হয় বসন্তকালে। অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী, এটাই হল এই উৎসবের মূল বক্তব্য। প্রধানত বৌদ্ধ মঠের মধ্যেই উৎসব পালিত হয় তবে শহরের বিভিন্ন জায়গায়ও এর আয়োজন হয়। ভূটানী 'থাঙ্কা', মানে সিল্কের কাপড়ের ওপরে পেন্টিং প্রদর্শিত হয়, যাতে গুরু পদ্মসম্ভবের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্নিত হয়। এই থাঙ্কা কেনার একটা বাসনা ছিল কিন্তঙ ছোট ছোট থাঙ্কারও এত বেশী দাম যে শেষ পর্যন্ত আর তা হয়ে ওঠেনি। আর তাছাড়া নকল থাঙ্কায় বাজার ছেয়ে আছে। আসল নকলের তফাৎ হয়ত বুঝতেই পারব না।

আমরা ঘুরতে বেরিয়ে দেখলাম কী ভিড় রাস্তায়! দলে দলে মানুষ চারিদিকে, কারণ সেদিন ছিল উৎসবের শেষ দিন। চারিদিক আলো দিয়ে সাজানো। হোটেলের পেছন দিকের রাস্তায় একটা ময়দানের মতো জায়গায় জনাসমাগম হয়েছে প্রচুর, সেখানে দিকে দিকে নাচ, গান হচ্ছে। বেশিক্ষণ অচেনা জায়গায়, ঠান্ডার মধ্যে আর না ঘুরে হোটেলে ফিরে এসে, ক্যারাওকে বারে বসে বিয়ার খেয়ে, নীচের রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে নিলাম। পরদিন আবার ন'টায় ওরা এসে যাবে। থিম্পু দর্শন হবে সারাদিন।

পরদিন ঘুম ভাঙল, দেখলাম একটা ঝলমলে দিন। আগের দিনের মেঘলা আকাশ পরিষ্কার আজ। আমরা তাড়াতাড়িই ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে নিলাম। টিলেরাও ন'টা নাগাদ এসে গেল। প্রথমে আমরা যাব ভূটানের সবচেয়ে সুন্দর বৌদ্ধ মন্দিরে, যাকে বলে 'ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন'। শহরের একবারে মাঝখানে ১৯৭৪ সালে এই বৌদ্ধ মঠটি স্থাপনা করা হয়। এই মঠটির মাথায় যে সোনালী চূড়া আর ঘন্টা আছে সেটা অনেক দূর থেকে দেখা যায়। তৃতীয় রাজা ড্রাক গ্যালপো বা জিগমে দোরজি ওয়াংচুকের সম্মানে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এই জিগমে দোরজি ওয়াংচুকের দূরদর্শিতার প্রতিফলন আজকের ভূটান। ভূটানকে রাজতন্ত্র থেকে গনতন্ত্রের পথে উন্নীত করার পেছনেও তাঁর বিরাট অবদান। বিশ্বের দরবারে নিজের দেশের সংস্কৃতিকে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। প্রায় কুড়ি বছর রাজত্ব করার পরে হঠাৎই হার্টের চিকিৎসার জন্য নাইরোবিতে গিয়ে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কৃষিকাজে উন্নয়ন সব ব্যাপারেই ভারতের সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন।

১৯০৭ সালে উগেন ওয়াংচুক ব্রিটিশদের সাহায্যে প্রথম এই দেশের রাজা হন। ১৯২৬ সালে ওঁনার মৃত্যুর পরে ছেলে জিগমে ওয়াংচুক দ্বিতীয় রাজা হন। ভারতের স্বাধীনতার পরে ১৯৪৯ সালে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ১৯৫২ সালে তাঁর ছেলে তিন নম্বর রাজা হলেন জিগমে দোরজি।

ওঁনার হঠাৎ মৃত্যুর পরে ষোল বছরের ছেলে জিগমে সিংগে রাজ সিংহাসনে বসলেন ১৯৭২ সালে। এখনকার রাজা হলেন জিগমে খেসর ওয়াংচুক, একশো বছর ধরে রাজত্ব করে চলা রাজবংশের পঞ্চম রাজা। বাবা জিগমে সিংগে একসাথে চার বোনকে বিয়ে করেছিলেন। তবে তৃতীয় রাণীর সন্তান জিগমে খেসর রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র। ২০০৮ সালে বাবা সিংহাসন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে এই ছেলেই বর্তমান রাজা।

(পঞ্চম রাজা জিগমে খেসরের রাণীর নাম পেমা। এদের প্রেমের কাহিনী একেবারে রূপকথার গল্পের মতো। পেমার যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন এক পারিবারিক পিকনিকে গিয়ে তরুণ রাজপুত্রকে দেখে তার হাত ধরে বলেছিলেন, "আমি তোমার সঙ্গে যাব, আমাকে বিয়ে করবে"?

সতেরো বছরের তরুণ অবাক হয়ে বলেছিল, "যদি কোনও দিন সঠিক সময় আসে তাহলে নিশ্চয়ই করব"।

এরপর চোদ্দ বছর কেটে যায়, আবার তাদের দেখা হয়, তখন একুশ বছরের তরুণী পেমা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আর সেই রাজপুত্র ততদিনে দেশের রাজা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই বিদূষী, সুন্দরীকে আবার দেখে, আলাপ করে রাজা জিগমে খেসর মুগ্ধ হয়ে যান এবং সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করেন না যে, এই হবে তাঁর রাণী। এখন এই রাজা-রাণীর সুখের সংসার, তাদের তিনটি ছেলেমেয়ে। প্রথম দুই পুত্র সন্তানের পরে ২০২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রাণীর একটি কন্যার জন্ম হয়।)

আমরা গতবছর ঐ সময়ই গিয়ে চারিদিকে রাজা-রাণীর ছবি, রাণীকে কন্যার জন্মের জন্য অভিনন্দনের ছবি চোখে পড়ল।

যাই হোক, এবার আবার ফিরে আসি ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন-এর কথায়। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। এই টিকিট কাটার ব্যাপারে টিলে সবসময়ই এগিয়ে আসত। দেবাশিস পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকত। সব জায়গাতেই টিলে বলত দুজনের জন্য পুরো টাকাই লেগেছে। আমরা তাই বিশ্বাস করতাম কিন্তু ভ্রমণ পর্বের একেবারে শেষের দিকে একটু সন্দেহ হওয়াতে টিকিট কাউন্টারে নিজেরা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আসলে টিকিটের দাম বেশ কম। ব্যালান্স টাকাটা ফেরত দেওয়ার অভ্যাসটা টিলের ছিল না।

এখানে গেট দিয়ে ঢুকে সামনে বেশ সুন্দর বিশাল বাগান। বাঁ পাশে প্রেয়ার হুইল আছে অনেকগুলো। লামারা, সাধারণ মানুষেরা সবাই এই প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে প্রার্থনা করে রোজ। মঠের ভেতর তিনতলার মন্দির। পদ্মসম্ভবের বিরাট মূর্তি। প্রত্যেক তলায় বিচিত্র সব ধর্মীয় মূর্তি।

এই পদ্মসম্ভব একজন ভারতীয় বৌদ্ধ গুরু যিনি অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। (এখনকার পাকিস্তানের সোয়াত প্রদেশে উনি জন্মেছিলেন। তখনকার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের দুটি ভাগ, মহাযান আর বজ্রযান। বজ্রযান হল তন্ত্র মন্ত্র সমৃদ্ধ। গুরু পদ্মসম্ভব ছিলেন বজ্রযানপন্থী। ওঁনাকে রিং পো চে-ও বলা হয়। কথিত আছে পদ্মফুলের থেকে ওঁনার জন্ম। এখনকার সোয়াত প্রদেশের প্রাচীন নাম ছিল উদয়ন বা সুবাস্তু। এখানকার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই এই নামকরণ হয়েছিল।)

অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে গুরু রিং পো চে ভূটানের বুমথাং বলে যে জায়গায় এসেছিলেন সেখানে এখনও উৎসব পালিত হয়। ওঁনার হাত ধরেই ভূটানে বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ঘটে।

যাই হোক, এখান থেকে বেরিয়ে আমরা পরবর্তী দ্রষ্টব্য দেখতে যাই। বুদ্ধ ডোরডেনমা স্ট্যাচু প্রায় দশ বছর ধরে রাজা জিগমে সিংগের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে। ১৬৯ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের এই বুদ্ধ মূর্তি সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাইরে বিশাল প্রাঙ্গনের মাঝখানে এটি অদ্ভুত সুন্দর। পেছনে বড় হলের মধ্যে আরও অনেক ছোট বড় বুদ্ধের মূর্তির সাথে গুরু রিমপোচেরও অনেক মূর্তি রাখা আছে। এই জায়গাটি বুদ্ধ পয়েন্ট বা কুয়েনসেল ফোদরং বলেও পরিচিত। বুদ্ধ পয়েন্ট চারিদিকের বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়ের মাঝখানে এক টুকরো শান্তির জায়গা।

এরপর এখান থেকে আমরা গেলাম 'মোতিথাং টাকিন প্রিসার্ভ পার্ক-এ। এখানে রয়েছে একটা অদ্ভুত দেখতে জন্তু যাকে 'টাকিন' বলে। ছাগল আর গরুর একটা মিশ্রিত চেহারা, এই প্রাণীরা এখন অবলুপ্তির পথে। এদেরকে সরকার থেকে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করা হচ্ছে। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটু কফিও খাওয়া হল। টিলেও সঙ্গে ছিল। ড্রাইভার কেদার বাইরে গাড়ীতে বসেছিল। এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম 'ফোক হেরিটেজ মিউজিয়ম' দেখতে। এখানে ১৫০ বছরের পুরোনো মাটি আর কাঠের তৈরী একটা তিনতলা বাড়ী আছে। সেখানে তখনকার আমলের যা কিছু সব সুন্দরভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। বাড়ীর একতলায় আছে শস্যের মড়াই জাতীয় বস্তু স্টোর করার জায়গা। ঠিক যেমন আমাদের দেশেও পুরোনো দিনের বাড়ীগুলোতে থাকত। এখান থেকে আমরা চালভাজা কিনে এনেছিলাম। বাড়ী সংলগ্ন ক্ষেতে উৎপন্ন হচ্ছে ধান, বাজরা এইসব। দেশীয় মদও এখানে তৈরী করে বিক্রি করা হয়। কেমনভাবে ধান ভেনে চাল বার করে সেই চাল ভাজা হচ্ছে বা কিভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে শস্য দানার থেকে মদ তৈরী হচ্ছে তাও সেইসব পুরোনো সময়ের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কয়েকজন কর্মচারী আছে। বাড়ীর তিন তলায় উঠতে হচ্ছে কবেকার সেই উঁচু উঁচু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। বোঝাই যায় এই কাজটি তখনকার বাসিন্দাদের করতে হতো দিনের মধ্যে কতবার! তাদের কি আর শরীরে প্রেসার, সুগার, হাঁটুর ব্যথা থাকতে পারে? কায়িক পরিশ্রম থেকে আমরা শহরের নাগরিকরা অনেক দূরে সরে এসেছি বলেই আজকাল এমন একটা লোক খুঁজে বের করা যাবেনা যার এসব রোগ নেই!

এখান থেকে বেরিয়ে টিলে আমাদের নিয়ে গেল একটা ট্র্যাডিশনাল ভূটানী রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খাওয়াতে। অর্ণব যে প্ল্যান করে দিয়েছিল বা itinery ঠিক করেছিল তার মধ্যে এটাও পড়ে। আমাদের গাড়ী দাঁড়াল একটা বেশ পুরনো বাড়ির সামনে। পরে জানলাম যে একটা প্রাচীন বাড়ীকে সংস্কার করে কোনো প্রতিষ্ঠান এই রেস্টুরেন্ট চালু করেছে। প্রাচীনকালের বাড়ী, তার আসবাবপত্র সত্যিই দেখার মতো। তেমন রাজকীয় কিছু নয় কিন্তু সাধারণ অবস্থাপন্ন মানুষের থাকার জায়গা কেমন ছিল সে সম্বন্ধে ধারণা হল। একটা সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ঘরে এলাম। আমরা তো অতি সাবধানে চড়লাম কারণ বেড়াতে এসে পড়ে টড়ে গেলে মহাবিপদ। টিলে আর কেদার নীচেই কোথাও বসে খেল। ওপরে বসার ব্যবস্থা মাটিতে গদি পেতে আর সামনের নিচু টেবিলে খাবার দিয়ে গেল। আমি তো বেশ উত্তেজিত, নতুন নতুন cuisine try করতে আমার খুব ভাল লাগে। আমাদের সবই উল্টো, এটাও তাই। দেবাশিস আবার পছন্দ করেনা। সারা পৃথিবী ঘুরেও সেই বাঙালী খাবারে আসক্তি! নিদেনপক্ষে ভারতীয় খাবার পেলেও চলবে।

একে একে সব খাবার আসতে লাগল। সব কাঠের বাসনে। বাড়ীর পেছন দিকের লনে বাইরে বসে খাবার ব্যবস্থাও আছে। যতটা আগ্রহ ছিল খাবার আগে ঠিক ততটা রইল না খেয়ে উঠে। তবে খাবার খুব ফ্রেশ কিন্তু স্বাদগুলো একটু আলুনী গোছের। ভারতীয় বিশেষত বাঙালী জিভের তাই মনে হল। এদের খাবারের দামও বেশ বেশি। আসলে ইউরোপ/অ্যামেরিকার পর্যটকদের জন্য আরও এসব আয়োজন। চীজ পটেটো অবশ্য ভাল লাগল, এরা পর্ক খায়, সেটার একটা পদও ভাল, একটা পালং শাক, মুচমুচে করে ভাজা সেটাও দারুণ। ঘাসও ডিপ ফ্রাই করলে খেতে ভালই হবে। ভাতই এদের মূল খাদ্য। তবে এরা লুচি, ছোলের ব্যবস্থাও রেখেছে। আর কিছুই ভাল না মনে হলে, এটাও আছে।

যাই হোক খাওয়ার শেষে আবার সেই ভয়াবহ সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নীচে নামলাম। টিলেদের খাওয়াও শেষ।

এবার আবার যাত্রা শুরু হল। আমরা দো চুলা পাস হয়ে যাব পুনাখা। থিম্পুতে আর ফেরা নেই। পুনাখা আর পারো'র কথা লিখব আবার অন্য কোনো সময়।

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।