শোলের বিল - যে বিলে শোল মাছ কিলবিল করে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। পাঁচ গ্রামের মানুষ জালে, দোয়াড়ি আটলে শোল ধরে। আমন ধানের মোটা লালচালের ভাত, শোলের ঝোলে মাখামাখি করে চাষা কৃষাণরা দুই/তিন পোয়া চালের ভাত সাবাড় করে দেয়। গায়ে- গতরে সব অসুরের বল! কোমর জলের মধ্যে দিয়ে আমনধানের বোঝা টেনে ডাঙায় তোলে। হাঁটু ছোঁয়া কাদায় মই দিতে বলদ লাগে না। শীতে ছেলের দলে আল বেঁধে, জল সেচে ঝুড়ি ভ’রে মাছ নিয়ে বাড়ি মুখো হয়। জলকাদা শুকিয়ে টান ধরে চামড়ায়। হাত-পা, ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। গিন্নিরা পাচন লাঠি নিয়ে ছেলে শাসায়। অবেলায় মাছের ঝুড়ি কাটা, বাছা করতে হাত-পায়ে টাস ধরে যায়। বিলে সাপের উপদ্রব। আজ ওর কাটে তো, কাল অন্যজনের। ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই কচুর শাকের মতো নেতিয়ে পড়ে। শোনা যায় ওঝাদের রেষারেষিতে বিষ মাথায় ওঠা-নামার যাতাকলে প্রাণ হারায় অনেকে। কান্নার রোল ওঠে। বছরে দুই/চার পরিবারে শোকের ঝড় বয়ে যায়। চাষী-জনখাটাদের শোক বিলাসিতা বেশিদিন টেকে না। আবার বিল মুখো হয়।
খ্যান্তির মতো বাগদিপাড়ার মেয়েরা বিলের কচু, ঘেচু, সাপলা, কমলি তুলে বাজারে বেচে, সাত/আট ছেলে-মেয়ের পাতে নুন দিয়ে সিদ্ধ করে দেয়। সেই খ্যান্তি ঝরাধান কুড়াতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা হারালো। ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে মুঠোমুঠো ধান বের করে চাঙাড়িতে রাখছিল। শীত বিকেলের কুয়াশা জড়ানো রোদে মুখটি জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছিল। উবুড় হয়ে হাত একেবারে বগল পর্যন্ত গর্তে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাতে ঠেকল ঠাণ্ডা কিছু। কিসে যেন কামড়ে ধরেছে দুই আঙুল। সর্বশক্তি দিয়ে হাত টেনে বার করে আনে। আঙুলের মাথায় ঝুলছে কালকেউটে। হাত ঝাড়া দিতেই কিলবিল করে গর্তে ঢুকে গেল। বিষের জ্বালায় খ্যান্তি কুঁকড়ে যায়। হারাণ কৈবর্ত ধানের গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। খ্যান্তির পড়ে যাওয়া দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে ছুটে যায় ওর কাছে। মুখে গ্যাজলা উঠে গেছে। গড়িয়ে পড়ছে নীল গাল বেয়ে। হারাণের হাকডাকে অনেকেই ছুটে এল। দাঁড়িয়ে দেখল দুঃখিনী খ্যান্তির মৃত্যু। হারাণ কৈবর্তের দাদাকে গেল বছর খালের মুখে মাছ ধরতে সাপে কেটেছিল। হারাণ,কোমরের গামছা কোষে বেঁধে সোজা শক্তিনগর হাসপাতালে যায়। সাপের নাম বলতে না পারায় ডাক্তার দের সঠিক ইনজেকশন দিতে দেরি হওয়ায় দুনিয়াদারী সাঙ্গ হয়েছিল। লোকটি সুদখোর টাকার কুমির ছিল। অনেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। সুদের টাকা শোধ দিতে হবে না। সে আনন্দ বেশিদিন থাকল না। স্বামী হারানোর যন্ত্রনাকে ভুলিয়ে দিল সুদের টাকা আদায় চরকিতে। মানুষ নেই তাতে কী, তার স্বামীর হকের টাকার হক একপয়সা ছাড়ার পাত্রী নয় সে। খ্যান্তি চরম অভাবে ১০০ টাকা ধার নিয়েছিল। সুদে -আসলে জমে উঠেছিল অনেক। সে ধার, ‘গতর দিয়ে শোধ দিতে হবে’ - বলতে মুখে আটকায়নি। এই ‘গতর’ দিয়ে শোধ করার কথাটি হারাণের দাদার মুখে লেগেই থাকত। চোখ দুটো জুলজুল করত। মেয়ে- বউরা তফাৎ দিয়ে চলার চেষ্টা করত। উঠোন বোঝায় আমন ধানের পাহাড়, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ পড়ে রইলো।
টানাবেলা আসার আগ পর্যন্ত ভেজা আমন ধান উঠোনে ডাই করা থাকে অনেক চাষীর। যৌথ পরিবারের গিন্নিদের সন্ধ্যের আগে স্নান হয় না। শুকিয়ে, উড়িয়ে গোলায় তুলতে চোত এসে যাবে। ব্যথা-বিষে রাতে ঘুম আসে না। কত্তাদের সেদিকে নজর থাকে না। সময়ে গরম ভাতের থালা সামনে পেলেই হল। শাশুড়ির গালমন্দ শুনে বউ, ঝিদের বিলের জলে ডুবে মরার সাধ জাগে। বালবাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জলে সে সাধ ভাসিয়ে দেয়।
বিলের জল খাল দিয়ে অঞ্জনাতে এসে পড়ে। বন্যা হলে খালের জল পড়ত অঞ্জনাতে। এখন জলও নেই, মাছও নেই - নামটা থেকে গেছে। বিলে ছিল সাপের উপদ্রব। চাষের কাজ অথবা মাছ ধরতে এসে গ্রামবাসীগণ বিপদে পড়ত। জনা পাঁচেক যাত্রাপুরবাসী সর্প দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মাঠের মধ্যে একটু উঁচু জায়গায় বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, সড়া, জবডুমুর ও খেজুর গাছের চারা পুতে ফণিমনসা গাছের নীচে পুজো দেওয়ার প্রচলন করেন। এখানে সর্পদেবী ঢেলাইচণ্ডী মাতা নামে পূজিতা হন। সেই কারণে মেলার নাম হয়েছে ‘ঢেলাইচণ্ডী মেলা’। মেলার বয়স চল্লিশ বছরের বেশি। ধান কাটার পর চাষ পড়েছে কী,পড়েনি তার মধ্যেই বসে মেলা। পৌষমাসের প্রত্যেক শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসে। পাঁচটি গ্রাম বিলটিকে সবুজ চাদরে ঘিরে রেখেছে। বর্ষার সময় কমবেশি জল হয়। থাকে ২/১মাস। অন্য সময় খটখটে মাঠ। শীতেই বিলের মাটি ফেটে চৌচির। খুব রোদ হলে ভাব ওঠে। চাষ দেওয়া জমির মাটি খোয়ার মত শক্ত। বিশ-ত্রিশ গ্রামের মানুষ আসে মেলায়। বড়োবড়ো কড়াইতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। পুজো দেয়। সূর্যাস্তের সঙ্গে মেলা শেষ হয়ে যায়। অগণিত মানুষ মাটিতে বসে খিচুড়ি খায়। প্লাস্টিকের থালা- গ্লাস চাষের জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দৃষ্টিনন্দন নয়। কালক্রমে জমি বন্ধা হয়ে পড়বে। মানুষের সচেতনতার অভাব পরির ভালো লাগে না। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় মনসা তলায়। দাঁড়িয়ে পড়ে; চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ছোটো-বড়ো ঢিল মাথায় করে মনসা থানের ঢাল বেয়ে উঠে এসে নামিয়ে দিচ্ছে। ঢিলের ছোটোবড়ো স্তুপ। গাছে ঝুলছে অসংখ্য মানতের ঢিল। নতুন সরাতে দুধকলা দিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে পুজো দিচ্ছে অনেকে। এখানে মানত করে, যাদের কোল আলো হয়ে উঠেছে; তারা গোপাল পুজো দিয়েছে। মেলায় আসার নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। সুবিধা মতো আলপথ ধরে বা শূন্য বুকের জমি আড়াআড়ি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় মেলায়। হরেকরকম জিনিসের দোকান, খাবারের দোকানের ভিড়। পরির বেয়াই চুড়িমালার দোকান দিয়েছে। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে। দক্ষিণ যাত্রাপুরের দিকে বাউল গানের আসর জমে উঠেছে। বাঁশ বাগানের মাথায় লাল টকটকে থালার মতো সূর্য ম্লান হয়ে আসছে। তিনি ডুব দিলেই মেলা শেষ। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের জোর বাড়ছে। পরি বাউল গান শুনে বেয়াই মশায়ের দোকানে চলে আসে। মণিহারি দোকান গোছানোয় হাত লাগায়। পাশের লোহালক্কড়ের দোকানে খুন্তি নিয়ে দরকষাকষি চলছে। খুন্তি লোহার, না-স্টিলের, ক্রেতা যাচাই করছে। গলার স্বর চেনা মনে হওয়ায় পিছন ফেরে। ফুলটুসি? এ কোন সাজ? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। খুন্তি হাতে ফুলটুসিও।
(ক্রমশ)
আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।