বিবিধ

চলমান সময়ের কথকতা



সুমিত ঘোষ


[মন কী চায়? কিছু কি বোঝা যায়? মন যে দুর্গম বড়! কতটা ধরা পড়ে? লেখকের অস্বচ্ছ মনের কাঁচকে তো নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতে হয়। তাও কি যথেষ্ট? একদম নয়। তবে যদি দৈবাৎ ধরা পড়ে যায় কিছুটা স্পষ্ট কোনো ছবি, সেই দুর্গমতার কুহেলি সামান্য সরিয়ে দিলে তো মেলে ছবি। কিছু যার কল্পপ্রতিমা থেকে জন্ম হয় এক বাকপ্রতিমা। সেই তো প্রাপ্তি! সেই তো মুক্তি! কার শৌনকের? না তো লেখকের! শৌনক কি বলেন!]

চলমান এই সময়ের সূতো ধরে আমরা মহানাগরিকরা এগিয়ে চলেছি। সময়ের নিরিখে এই এগোনো কতটা যথার্থ চিন্তন, মনন আর হৃদয় সঞ্জাত? সৃজনশীলতার পথে কতটা এগোতে পেরেছি তাতে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন তো থেকেই যায়। কেউ যে সে পথে এগোতে পারেন নি, তা বললে আবার অনৃতভাষণ হবে। আসলে বলা চলে এ এক দুই পথের দ্বন্দ্বের খেলা। চিরাচরিত শুধুই আত্মোন্নতি কেবল নিজের কেরিয়ার, অর্থ, স্টেটাস আর সামাজিক প্রতিপত্তির এই ঘটমান দৃশ্যমান রেস দেখতে দেখতে ক্লান্ত শৌনক।

শৌনক, আজ অধুনার মর্মকে অন্তরাত্মায় ধরতে চায়। হায়, এ এমন অধরা পিচ্ছিল যে, তা কেবলই পালায়। কোথায় তার গন্তব্য কোথায় তার চলমানতা কী তার উপজীব্য! পাঠকদের প্রশ্ন করে শৌনক। যদি তাঁরা এসবের কোন হদিস পান। এক প্রয়াত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার বলেছিলেন "ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস কর।" আমাদের খুব একটা কী ভাবা প্র্যাকটিস করা হল? শৌনক তবু ভাবতে চায়, ভাবাতে চায় পাঠককে। তাই একদিন ক্লান্ত হওয়া তার অভিধান বয়কট করতে চায়। প্রকৃতিস্থ, স্বাভাবিক, মানবিক, সংবেদনশীল কোন রাজ্য, দেশ, সমাজ কী ভাবনায়, দৃশ্যমানতায় আছে? বলুন পাঠকবৃন্দ শৌনক উবাচ আপনাদের মন এখন কী ভাবনায়, কোন দিব্য প্রাঙ্গণে ভ্রমণ করছে!

দম্ দমা দম্ ঝম ঝম ঝম বাজছে ব্যাণ্ড, ইনস্ট্যান্ট লিরিক, চিড়িক মিড়িক স্টিরিয়োফোনিক সংস্কৃতি! আউল-বাউল, রক্ এণ্ড রোল, বল হরি বোল, ডিস্কো- হুইস্কি উত্তরাধুনিক কৃষ্টি-রীতি!... ও মাই লাভ্ দিস্ সুইট হাব্ ইজ্ এয়োয়েটিং ইওর গ্রেশাস্ প্রেজেন্স! অতঃপর একজন কুশীলব মহোদয় মঞ্চে দৃশ্যমান হইলেন... তিনি কহিলেন, আহা কি কহিলেন... পোষ্ট মডার্ন একটি মাইণ্ড-ব্লোয়িং পারফরম্যান্স, একটা ঝিকঝ্যাক্ বেলী ড্যান্স। আরে বল তিনি কি কহিলেন... ওহো আচ্ছা... তিনি কহিলেন আহা! যাহা কহিলেন তাহা শ্রবণেন্দ্রিয়ে পশিবা মাত্র আমাদের মানে এই উন্নত মানের এলিট আমজনতার চিত্ত বিগলিত হইল... আরে দূর্ মশাই কী-ই-ই-ই-ই কহিলেন?...

কহিলেন, "এই রিয়েলিজম প্রেজেন্টেশন আজ আপনাদের সারারাত জুড়ে ধামাকা শোনাবে।" কে এক বেরসিক বুড়ো যেন ফিসফিস করে বললেন, "এত সমৃদ্ধ আমাদের সাংস্কৃতিক আর সাংগীতিক ঐতিহ্য। কত সুন্দর কম্পোজিশন লিরিক কত বড় সব শিল্পী! তা খামোকা ধামাকার ধাক্কা কেন রে বাপ্।" আর আ-আর কিছুই করার নেই গো হে প্রবীণ মানুষ।। ঐ যে বলছে হ্যাণ্ডমাইক ডান হাতের গ্রিপে রেখে, "লেডিজ্ অ্যান্ড জেনটলমেন, উই আর নাউ গোয়িং টু প্রেজেন্ট..." ষ্টেজ জুড়ে আলোর রোশনাই... রঙের ফোয়ারায় এক অদ্ভুত যাদুবিশ্ব উন্মোচিত হয়ে চলেছে, সেই সেলিব্রিটি-সমাগমে গমগম করছে অডিটোরিয়াম... আর জোর হাততালি পড়তে থাকুক।... আর এই নক্ষত্ররা আরও আরও উড়ে এল যেন থ্রিডি মুভির মতো কানের পাশ দিয়ে, চোখের ওপর ভ্রূ ছুঁতে ছুঁতে, কখনও বা আকাশ থেকে খসে পড়ছে... আঃ। কী-ই-ই-ই-ই নন্দন না নন্দনকানন!

অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা যখন হাত ধরে চলে, অন্ধকার যখন মুক্ত জোনাকির বিন্দু বিন্দু আলোর সঙ্গে সঙ্গত করে, তখন তা বেশ রমণীয়। গম্ভীর আর গভীর অন্ধকার আমাকে বোধের জগতে নিয়ে যায়! আমাকে উদ্ভাসিত করে প্রজ্ঞার আলো। শৌনক, বড় অন্ধকার দেখে সব! অন্ধকার! অথচ তার কোনো এক অদ্ভুত তৃষ্ণা ভাবনায় জারিত হতেই চায়! ভাবনার উচ্চশিখরে মন পৌঁছে যায় কিন্তু থাকতেই পারে না বেশিক্ষণ! যেন গড়ানে পাহাড়ের পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নেমে আসে। তখন এক বিবমিষা, এক অর্থহীনতা যেন অসম্ভব শক্তিমানতায় শৌনককে দুর্বহ যন্ত্রণায় কাহিল করে! তবু ভাবনারা গুটি গুটি পায়ে ওর কাছেই ফিরে আসে। শক্তি সঞ্জীবনী দিয়ে শৌনককে উদ্ভাসিত করে।

শৌনক, কীসের আর্তি তোমার! কেন এই দ্বন্দ্বের উত্তাল ঢেউ নিয়ত তোমার ভাবনার সৈকতে আসে যায়! তুমি কোন অচিন দেশের সমাজ খুঁজছ? কোন দূষণবিহীন অবারিত প্রকৃতির তপস্যায় তন্ময় থাকো দিনরাত?

আকাশ আজ ধূসর - বড় বেশী ধূসর। বাতাসে ভাইরাস! নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন, ভয়াবহ ঋতুর বিন্যাস বিপর্যয়, অন্তর্দেশীয় যুদ্ধ, দেশের মানুষের শোষণ, দুঃশাসন, অবিচার আর লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ইন্ধন জোগানো সাম্প্রদায়িক বিরোধ এসব নিয়ে মানুষ আজ হাঁসফাঁস করছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে নতুন আঙ্গিকে পুঁজিবাদের রমরমা, এসব কিছুই আজ এক অদ্ভুত অন্ধকার এনেছে। শৌনকের চিন্তন, অনুভব, মেধা আজ এই সার্বিক বিপর্যস্ত সমাজের পরিস্থিতির মাঝখানেই আলোর উৎস খুঁজে বেড়ায়। আমি শৌনককে বলি, "তোমার এই নিরন্তর কেন এসব নিয়ে উতলা থাকা, দুঃখে অধীর থাকা। এমনিতেই আমাদের জীবনের কত সমস্যা, প্রতিকূলতা - এই নিয়েই তো কম জেরবার হতে হয়নি। তার ওপর আবার এই সমাজ, মানুষ, প্রকৃতির ভাবনা ভেবে মাথা খারাপ করার কোন মানে হয় কী!" শৌনক বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলে, "একটু তলিয়ে ভেবে দেখ, এসবই একসঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তুমি পালাবে কোথায়? কেমন করে? আসলে কী জান, আমাদের চেতনা আছে, কিন্তু চৈতন্য নেই।" সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের গান তখন পাড়ার শ্যামাপূজার মাইকে বেজেই চলেছে, "আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী।"