বিবিধ

হেরেছিলেন ড্রেসিংরুমের খেলায়



দেবাশিস সেনগুপ্ত


সঙ্গের ছবিটা দেখুন। ছবির পশ্চাৎপটে ভারতের জাতীয় পতাকা ও তার সামনের লোকটাকে দেখুন। লোকটা যে কোনো মাঠে ভারতের হয়ে বোলিং আর ব্যাটিং করতে এলে তার বোলিং আর ব্যাটিংয়ের মধ্যে ভারতের জাতীয় পতাকাই দেখতে পেতাম।

তার ডানহাতিদের জন্য অফস্পিনে (যা বাঁহাতিদের জন্য হয়ে যেত লেগস্পিন) নিশ্চিন্ত থাকতেন খুব কম ব্যাটসম্যানই। কিন্তু তিনি নিজে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ততায় কাটিয়েছিলেন তার ২০২১-এর গ্রীষ্ম-বর্ষার বিলেত সফরটা। এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি যে ডাগআউট থেকে মুক্তি অর্জন করে খালি পায়ে একা একা গ্যালারীতে বসেও খেলা দেখেছেন ২০২১-এ ইংল্যান্ডের ৪র্থ টেস্টে। টোটাল বিন্দাস যাকে বলে। খেলা নেই, তাই চিন্তাও নেই। তখন কোচ আর ক্যাপ্টেনের জুড়ির টিম ফর্মেশনের হিসেবের মধ্যে তাকে ধরা হয়নি। আজ অবসরপূর্ব আলিঙ্গনের আবেগাচ্ছন্ন মুহূর্তে সেই দিনগুলি কি লম্বা ছায়া ফেলছিল?

দেশের মাঠে ২০২৩ বিশ্বকাপে অজিদের বিরুদ্ধে তার ঘরের মাঠে ১ম ম্যাচে ১০-১-৩৪-১ হিসেবের পরেও অশ্বিনের ওডিআই কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল নিঃশব্দে। ফাইনালের আগে অবধি সব ম্যাচে অনায়াসে ম্যাচ জিতে চলা ভারত তাকে ছেঁটে ফেলেছিল ক্লিনিক্যাল দক্ষতায়। তখন কোচ আর ক্যাপ্টেনের জুটির টিম ফর্মেশনের হিসেবের মধ্যে তাকে ধরা হয়নি। ব্রিসবেনে তার অবসরোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনের আবেগাপ্লুত মুহূর্তে সেই দিনগুলি কি মৃদু ছায়া ফেলছিল?

সব ধূসর ছায়া সরিয়ে রেখে সেদিন তিনি খেলা আর না খেলার সীমান্ত পেরিয়ে গেলেন, যেভাবে তিনি পেরিয়ে যেতেন বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটকে, তার স্পিন দিয়ে। অন্যদের অহেতুক পাত্তা না দেওয়ার কারণেই অধিনায়কদের 'স্নেহ' পাওয়ার দিক থেকে চিরকালীন 'হতভাগ্য' তিনি, এতৎসত্ত্বেও ১৩ বছরের টেস্ট (২০২৪-এর ৬-৮ ডিসেম্বরে অ্যাডিলেডে শেষ টেস্ট খেলেছেন), ১২ বছরের ওডিআই (মূলত ৭ বছরের, ২০২৩-এর অক্টোবরে শেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন বিশ্বকাপে অজিদের বিরুদ্ধে) আর ১৩ বছরেরই (মূলত ৭ বছরের, ২০২২-এর নভেম্বরে শেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন) টি২০ কেরিয়ারে বিস্ময়কর দাগ রেখে গেছেন বিশ্বক্রিকেটে। ২০২১-এর জানুয়ারিতে ব্যাটে অস্ট্রেলিয়াকে আর ফেব্রুয়ারিতে বলে ইংল্যান্ডকে সংহারের দাগ তো এখনও টাটকাই। তবু পরের সিরিজেই ইংল্যান্ডে দর্শক হয়েই ছিলেন তিনি। তার আগে ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে ১৪ রান ডিফেন্ড করে ৯ রান দেওয়া আর তারপরে মেলবোর্ণ ২০২২ টি২০ বিশ্বকাপের গ্রুপ মাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে শেষ বল ছেড়ে দিয়ে ওয়াইড অর্জন করা আর ফ্রি হিটে ইনফিল্ড মিডঅফের উপর দিয়ে তুলে মেরে ১ রান নিয়ে ম্যাচ জেতা আজ কৃতজ্ঞরা ছাড়া সবাই ভুলে গেছে।

ইয়ান বথাম আর জ্যাক গ্রেগরীর সঙ্গে যুগ্মরেকর্ড তার, মাত্র ১১ টেস্ট খেলে ৫০ উইকেট আর ৫০০ রান করার। একটা সময়ে দ্রুততম ৫০, ১০০, ১৫০, ২০০, ২৫০, ৩০০ আর ৩৫০ উইকেট (যুগ্মভাবে মুরলিধরণের সঙ্গে ৬৬ ম্যাচে) নেওয়ার রেকর্ডও ছিল তার। জীবনের প্রথম ১৩ টেস্ট সিরিজের মধ্যেই সর্বোচ্চ ৬টি টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি, শচীন আর সেওয়াগকে পেরিয়ে, সেটা ২০১৬-র কথা। এখন অবশ্য ওই ৬ পৌঁছে গেছে ১১-তে। ১৯৭৯-৮০-তে কপিলদেবের হোমসিরিজে ৬৩টি উইকেট পাওয়ার রেকর্ড তিনি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ২০১৬-১৭ সালে, হোমসিরিজে মোট ৭২টি উইকেট নিয়ে। মুরলীধরণের ১৯১ টপকে তার টেস্টে শিকার বাঁহাতি ব্যাটের সংখ্যা ২৬৮। তার ১০৬ টেস্টে ১১ বার টেস্টে সিরিজ-সেরা খেলোয়াড় হওয়া এখন বিশ্বে ১ম, মুরলীধরণের ১৩৩ টেস্টে ১১ বারের ঠিক আগেই।

১০৬ টেস্টে তার ২৪.০০ গড়ে ৫৩৭ উইকেট (টেস্ট প্রতি ৫.০৭, দেশে ৩৮৩ আর বিদেশে ১৫৪), যার মধ্যে আছে ৩৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট (বিশ্বে যুগ্ম ২য় সর্বোচ্চ) আর ৮ বার ম্যাচে ১০ উইকেট। ইনিংস সেরা আর ম্যাচ সেরা বোলিং ছিল যথাক্রমে ৭/৫৯ ও ১৩/১৪০। সঙ্গে ব্যাটে ৬টি শতরান ও ১৪টি অর্ধশতরান সহ ৩৫০৩ রান। ১১৬ ওডিআইতে আছে ১৫৬ উইকেট, সেরা ৪/২৫, ২০২১-এর আগে শেষ ৪ বছর ওডিআই না খেলেও। সঙ্গে ব্যাটে ১টি অর্ধশতরান সহ ৭০৭ রান। ৬৫টি টি২০-তে আছে ৭২ উইকেট, সেরা ৪/৮। সঙ্গে ব্যাটে ১৮৪ রান। ২০২১-এর আগে শেষ ৪ বছর টি২০ খেলেননি। ২০২২-এর টি২০-র বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে ছিলেন, যেমন ৪ বছর পরে ফিরেছিলেন ২০২১-এর টি২০-র বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে। চাঁদের কলঙ্কর মতই আইপিএল-এ মানকাদীয় আউট এক চিরকালীন কাদার দাগ হয়ে থেকে গেছে লোকটার ক্রিকেট কিটে।

তার মোট ৭৬৫টি আন্তর্জাতিক উইকেট ভারতীয়দের মধ্যে ২য় সর্বোচ্চ, আগে শুধু অনিল কুম্বলের আন্তর্জাতিক ৯৫৩ উইকেট। ৫০০-র বেশি উইকেট নেওয়াতেও কুম্বলের পরে তিনিই ২য় ভারতীয় বোলার। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ১০০ উইকেট নেওয়া। তার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে মোট উইকেট ১৯৫। তার ঝুলিতে সব ধরণের ক্রিকেটে ৩০২টি বোল্ড আর এলবিডবল্যু আছে, যা মুরলিধরণ আর ওয়ার্নের পরে বিশ্বে ৩য়। একই টেস্টে শতরান করা আর ৫ উইকেট নেওয়া ৪ জন ভারতীয়র মধ্যে তিনি একজন, বাকিরা ভিনু মানকাদ, পলি উমরিগড় ও রবীন্দ্র জাদেজা। অবশ্য ৪ বার একই টেস্টে শতরান করা আর ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড ভারতে শুধু তারই দখলে (বিশ্বে ২য় সর্বোচ্চ), আর সর্বোচ্চ ৫ বার এ কাজ করার রেকর্ড ইয়ান বথামের। রেকর্ড করব বলে খেলা না, খেলতে খেলতে রেকর্ড হয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসীদের ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর ছিল লোকটা।

পরিবার ছিল তারও সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি। তা নিয়ে অবশ্য বিশেষ হাই প্রোফাইল শোরগোল হয়নি কখনো, কোনদিন। প্রবল কোমরের যন্ত্রণার দরুণ ২০২১-র সিডনি টেস্টের শেষদিনের ঠিক আগের নিদ্রাহীন রাতের কথা আনার বহু ভিডিওতে ধরা আছে, ধরা আছে সেই রাতে তার ফ্যামিলির অনুক্ত উৎকণ্ঠা ও পাশে থাকার কথাও। পরের দিন ভারতের জাতীয় পতাকাকে গর্বিত করেছিলেন ব্যাটার তিনি ও আর এক প্রবল আহত ব্যাটার হনুমা বিহারি, যা ভোলা কঠিন। পারিবারিক মূল্যবোধ ও শিক্ষার ভিতে গড়ে ওঠা সৌজন্যর দুর্গ কখনও ছেড়ে যায়নি তাকে।এই প্রজন্মের অত্যাধুনিক আবহে কখন যেন 'মিসফিট' হয়ে গিয়েছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন, যেখানে যোগ্যতা হয়ত আর শেষ কথা বলছিল না।

তিনি তার অফস্পিনের মোহময়ী ও সুদূরপ্রসারী জালে জড়িয়েছেন বহু প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে, কিন্তু নিজেই ক্রমাগত মুক্তি খুঁজে গেছেন নিজের গায়ে জড়িয়ে যাওয়া নিজেরই টিম ম্যানেজমেন্টের অনাস্থার জাল থেকে। সেই অনাস্থার জালকে ছিঁড়ে ফেলতে না পেরেই হয়ত ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে তিনি ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার দৌড়ে টেনে দিলেন এক অনতিক্রম্য দাঁড়ি, সেই সিডনি টেস্টের অদূরে দাঁড়িয়েই। বিশ্বক্রিকেটের ঘূর্ণি সার্কিটে এতদিন মন ভরিয়ে দিয়ে 'রবি'র আলোয় ভরে থাকা বিশ্বক্রিকেটের মহাকাশে থেকে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য তার। আজ থেকে আমাদের মত পুরোনো স্কুলের লোকজনের একটু অসুবিধা হবে, অশ্বিনসভ্যতা পরবর্তী 'রবি'হীন মেঘলা বিকেলের মতো ঘোলাটে বিশ্বক্রিকেটের দিকে দু'চোখ মেলে তাকাতে।

তের-চোদ্দ বছরের অভ্যেস তো!

শুভ হোক যথার্থ টিমম্যান ও ফ্যামিলিম্যান রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ২য় ইনিংস।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।