বিবিধ

রবীন্দ্র-কথা




আনন্দ ও আনন্দ

আনন্দ কেমন করিয়া আপনাকে প্রকাশ করে? প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে, সৌন্দর্যে। জগত প্রকাশে কোথাও দারিদ্র্য নাই, কৃপণতা নাই, যেটুকু মাত্র প্রয়োজন তাহারি মধ্যে সমস্ত অবসান নাই। এই যে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র হইতে আলোকের ঝর্ণা আকাশময় ঝরিয়া পড়িতেছে, যেখানে আসিয়া ঠেকিতেছে সেখানে বর্ণে তাপে প্রাণে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে, ইহা আনন্দের প্রাচুর্য। প্রয়োজন যতটুকু ইহা তাহার চেয়ে অনেক বেশি - ইহা অজস্র। বসন্তকালে লতা গুল্মের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে কুঁড়ি ধরিয়া ফুল ফুটিয়া পাতা গজাইয়া একেবারে যে মাতামাতি আরম্ভ হয়, আম্র শাখায় মুকুল ভরিয়া উঠিয়া তাহার তলদেশে অনর্থক রাশি রাশি ঝরিয়া পড়ে, ইহা আনন্দের প্রাচুর্য। সূর্যোদয়ে সূর্যাস্তে মেঘের মুখে যে কত পরিবর্তমান বিচিত্র রঙের পাগলামি প্রকাশ হইতে থাকে, ইহার কোন প্রয়োজন দেখি না - ইহা আনন্দের প্রাচুর্য। প্রভাতে পাখিদের শত শত কন্ঠ হইতে উদগীরিত স্বরের উচ্ছ্বাসে অরুণ গগনে যেন চারিদিক হইতে গানের হোরিখেলা চলিতে থাকে, ইহাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত, ইহা আনন্দেরই প্রাচুর্য। আনন্দ উদার, আনন্দ অকৃপণ - সৌন্দর্যে-সম্পদে আনন্দ আপনাকে নিঃশেষে বিলাইতে গিয়া আপনার আর অন্ত পায় না।

আনন্দ ও জ্ঞান

ভিত মাত্রই শক্ত হইয়া থাকে, না হইলে তাহা আশ্রয় দিতে পারেনা। যা কিছু ধারণ করিয়া থাকে, যাহা আকৃতিদান করে, তাহা কঠিন। মানুষের শরীর যতই নরম হোক না কেন, যদি শক্ত হাড়ের উপরে তাহার পত্তন না হইত তবে সে একটা পিণ্ড হইয়া থাকিত, তাহার চেহারা খুলিতই না। তেমনি জ্ঞানের ভিত্তিটাও শক্ত, আনন্দের ভিত্তিটাও শক্ত। জ্ঞানের ভিত্তি যদি শক্ত না হইত তবে তো সে কেবল খাপছাড়া স্বপ্ন হইত, আর আনন্দের ভিত্তি যদি শক্ত না হইত তবে তাহা নিতান্তই পাগলামি মাতলামি হইয়া উঠিত।

আনন্দের মহত্ত্ব

মানুষ কি জানে তাহাতে নয়, কিন্তু মানুষ কিসে আনন্দ পায় তাহাতেই মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষের সেই পরিচয়ই আমাদের কাছে ঔৎসুক্যজনক। যখন দেখি সত্যের জন্য কেহ নির্বাসন স্বীকার করিতেছে তখন সেই বীরপুরুষের আনন্দের পরিধি আমাদের হৃদয়ের সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া ওঠে। দেখিতে পাই, সে আনন্দ এত বড় জায়গা অধিকার করিয়া আছে যে, নির্বাসন দুঃখ অনায়াসে তাহার অঙ্গ হইয়াছে। এই দুঃখের দ্বারাই আনন্দের মহত্ত্ব প্রমাণ হইতেছে।

সৌজন্যেঃ অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।