সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই।
পরিচালনা - সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই' আসলে ১৯৮৯ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র 'এক রুকা হুয়া ফয়সালা'-র দ্বারা অনুপ্রাণিত একথা সৃজিত স্বয়ং বিভিন্ন আলাপচারিতায় জানিয়েছেন। আবার এই হিন্দি চলচ্চিত্রটি ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মার্কিন ছবি 'টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন'-এর রূপান্তর যার পরিচালক ছিলেন সিডনি লুমেট।
প্রথমেই আসি চলচ্চিত্রটির সাবজেক্ট নিয়ে। একটি হত্যা মামলার রায়দান নিশ্চিত করতে বারোজন সদস্যের একটি জুরি দল, যাঁরা আলোচনায় বসেন একটি সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে আসার জন্য। এক্ষেত্রে সৃজিত জজ-এর স্বপ্নের মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলিকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন।
শুরুতে একজন বাদে প্রত্যেকেই একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দোষী ধরে নিয়েই আলোচনা আরম্ভ করে। দর্শক দেখে প্রত্যেকটি চরিত্র ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় আবদ্ধ। কেবল পরমব্রত অভিনীত চরিত্র সত্য (যিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ) শুরু থেকেই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্নমত পোষণ করছেন এবং হত্যার ঘটনাটিকে ভিন্ন কৌনিকে যুক্তির দ্বারা বিচার করে রিক্রিয়েট করার চেষ্টা করছেন এবং সেখান থেকেই ধীরে ধীরে হত্যাকারীর হত্যা করার নিশ্চয়তা সম্পর্কে এক সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে।
একজন একজন করে সবাই নিজেদের মত সম্পর্কে নিজেরাই বিপরীতমুখী হয়ে উঠছেন। জুরি সদস্যদের প্রত্যেকের জীবনের অজানা ঘটনা, চরিত্র, যন্ত্রণার দিকগুলি উন্মোচিত হতে থাকে। মেকি জীবনের দেখনদারি, দুঃখ, গুলিয়ে যাওয়া ধর্মীয় মৌলবাদী বিশ্বাস, রাগ, হিংসা, ঘৃণা, সবকিছু মিলে সমাজের এক বাস্তব প্রেক্ষাপট।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন, যদিও অনেক জায়গায় 'ম্যানারিসম'-এ ভুগেছেন। আরোপিত অভিনয় মনে হয়েছে। জজ ব্রজেশ্বরের চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুমিতের ভূমিকায় ঋত্বিক চক্রবর্তী, অরুন্ধতীর চরিত্রে সৌরসেনী মৈত্র, সাদিকের চরিত্রে রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুদক্ষ অভিনয়ের উল্লেখ করতে হবে। অন্যান্য চরিত্রে কৌশিক সেন, অনন্যা চ্যাটার্জী, অর্জুন চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, ফাল্গুনী চ্যাটার্জী, সুহোত্রা মুখার্জি, প্রত্যেকেই নিজেদের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন।
গোটা সিনেমা জুড়ে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতি নজরে পড়ে। সৃজিতের পরিচালনায় এই সিনেমাটিকে শ্রেষ্ঠ বলা যেতেই পারে। সংলাপ নির্ভর সিনেমা বেশিরভাগ সময় বোরিং হয়ে ওঠে, কিন্তু এক্ষেত্রে দর্শক চোখের পলক ফেলতে পারেনি। টান টান স্মার্ট সিনেমাটোগ্রাফির উল্লেখ করতে হবে বিশেষ ভাবে। কখনও লং এঙ্গেল থেকে, কখনও বা চরিত্রকে গোটা পর্দা জুড়ে নিয়ে এসে, আলোর সঠিক ব্যবহারে মানুষের ডার্ক সাইডগুলিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন। এমনকি 'তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না' গানটিকে সুনিপুন ভাবে ব্যবহার করে মনে করিয়ে দিয়েছেন মানুষের মনের মধ্যে বিভিন্ন পৃথক ধর্মী মানুষ লুক্কায়িত থাকে।
সব মিলিয়ে বলাই যায় সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের এই কাজটি দর্শকের মনে থেকে যাবে বহুদিন।