গল্প ও অণুগল্প

ঈর্ষা



হুমায়ুন কবীর (বাংলাদেশ)


স্কুলের অন্য কক্ষগুলোর চেয়ে এ কক্ষটা একেবারেই আলাদা। দেওয়াল জুড়ে রঙিন ছবি, বর্ণ, সংখ্যা; মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু খেলনা। শ্রেণিতে গোটা-তিরিশের মতো শিক্ষার্থী আর একজন শিক্ষিকা - নাম মাহিদা পারভীন ডলি। স্কুলে ডলি আপা বলেই পরিচিত। ছড়ায়-গানে-খেলায় শিশুদের সাথে মিশে গেছে ডলি আপা। কখনও ছেলেমেয়েদের ছড়া শোনাচ্ছে, কখনওবা গান; কখনও শিশুতোষ খেলায় মেতে উঠছে তাদের সাথে। তাদের কাওকে ডাকছেন নাম ধরে, কাওকে বলছেন "লক্ষ্মী সোনা"।

সাথী নামে একটা মেয়ে বসে আছে দেওয়াল ঘেঁষে; অনেকটা চুপচাপ। সাথীর নিরানন্দ বসে থাকাটা ডলি আপার নজর এড়িয়ে যায়নি। ডলি আপা, আদর করে তাকে ডাকলেন, "মা, মা-মনি এসো, এসো - কাছে এসো"। সাথী দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে আসতেই আপা কোলে তুলে আদর করতে করতে বললেন - "সাথী আমাদের ভালো সাথী। আচ্ছা, সাথী তোমার কি মন খারাপ"? সাথী আধো আধো বোলে কী যে বলল ঠিক বোঝা গেল না - শুধু স্পষ্ট দেখা গেল তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ডলি আপা এতক্ষণে বোধহয় 'বর্ণপরিচয়' শেখাচ্ছিলেন; বলছিলেন ঐ-তে ঐরাবত, আ-তে আম। সহসা তার সৃজনশীল মনের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। তিনি গাইতে শুরু করলেন - "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি... আহা হা হা হা হা... আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি..."

ছেলেমেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করে গাইতে গাইতে বর্ষার মেঘ কেটে যাওয়া রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের নীচে নেমে এল।

সাথী শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করতে একটু দেরি করছে। আস্তে ধীরে ডলি আপার কাছে এসে অস্ফুট স্বরে বলে, "তুমি আমার মা হবে"?

ডলি আপা সাথীকে কোলে তুলে কপালে একটা চুমু দিতে দিতে বললেন, "হ্যাঁ - আজ থেকে আমি তোমার মা"।

সাথীর প্রতি ডলি আপার এই অপত্য স্নেহের কিছু কারণ দেখি। বাবা প্রবাসে থাকাকালে সাথীর মা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে - সে সম্পর্কে পাঠককে বিস্তারিত বলা সমীচীন হবে না। বঙ্কিমবাবু বলেছিলেন, যাকে ভালোবাসো তাকে চোখের আড়াল করিও না। সাথীর বাবা দীর্ঘ সময় ভালোবাসার মানুষটিকে আড়ালে রেখেছে - তাই এ দূর্ঘটনা। হতে পারে স্কুলের ম্যাডাম সাথীর মাতৃস্নেহের এই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে।

সাথী সহপাঠীদের সাথে বাড়ি ফেরে। সহপাঠীদের মা আছে, সাথী মা-হারা।বাড়ি ফেরার পথে কারো কারো মা এগিয়ে আসে। আদর করে কোলে তুলে নেয়, কেউ বা মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরে। অন্যদিন এসব দেখে সাথী ভাবে আমার মা নেই কেন? আজ কেন জানি - মায়ের শূন্যতা সাথীর মনে হচ্ছে না, সে কেবলই ভাবছে স্কুলে ডলি আপার কথা; তার কানে বাজছে - "হ্যাঁ, আজ থেকে আমি তোমার মা"।

স্কুলের দু'দিনের ছুটি শেষ হতে যাচ্ছে। এখন রাত, রাতটা পোহালেই স্কুল। সাথীর মনোজগত দখল করে আছে মাহিদা পারভীন ডলি আপা। মনে হচ্ছে, কখন খুলবে স্কুল? ডলি আপা ছড়াগান শোনাবে। সহসা বলে উঠবে - "এবার খেলা; আমিও তোমাদের সাথে খেলবো"। খেলার কোনো এক ফাঁকে তাকে আদর করে ডাকবে, বলবে "মা-মনি এসো, এসো কাছে এসো"। এমনটি ভাবতে ভাবতে কখন জানি তার দু'চোখ জুড়ে এসেছে ঘুম।

গভীর রজনী; বাড়ির সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। সাথীর বাবা হতচকিত হয়ে বললেন, "সাথী... সাথী কী হলো, মা? 'মা' 'মা' করে চেঁচাচ্ছিস কেন"? সাথীর ঘুম ভেঙে যায়। তবে, তার ঘুমের ঘোর রয়ে যায় চোখে - চারদিকে ইতিউতি চোখমেলে দেখল - না কোথাও স্কুলের ম্যাডাম নেই। তবে কে তার হাতের আঙুল ধরে হাঁটছিল? কে তাকে বলল - "আমি তোমার মা হবো"। শুধু চোখ রগড়াতে রগড়াতে দেখল বাবা জেগে আছে, ছোট বোন ঘুমিয়ে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, "স্বপ্ন দেখছিলি, সাথী"? সাথী বললো, "না বাবা কিছুই না..."

বাবা বললেন, "ও, আচ্ছা। তাহলে এবার ঘুমো, সকাল হওয়া অ-নে-ক দেরি"।

সাথীর ঘুম আসে না। মনে পড়ে ডলি ম্যাডামের মুখ। কাল কখন স্কুল শুরু হবে? কখন ডলি ম্যাডাম তাকে বলবে, "মা-মনি, তুমি বাড়ি থেকে কী দিয়ে খেয়ে এসেছো? এসো, খেলা করি, এই নাও তোমার ফুল, আমি নিলাম পাতা - আজ ফুল - পাতা খেলি, কেমন"?

এমনি কল্পনায় ভাসতে ভাসতে তার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। রাতের শেষ ভাগে বোধহয় একটু ঝিমুনি এসেছিল। কিছুক্ষণ বাদেই মসজিদ থেকে "আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নায়ুম" ধ্বনি ভেসে আসে। ভেসে আসে পাখির কলকাকলী। ঝরা পাতার মর্মরে পল্লবিত হয় সাথীর মন।

রাতের স্বপ্নকে বহন করে চলেছে সাথী।

পূব আকাশ আলোকিত করে উঠেছে থালার মতো এক লাল সূর্য। স্কুলে যাবার সময় - হ্যাঁ, সাথী চলেছে স্কুলে। বাঁশবাগানের নীচ দিয়ে, ছোট্ট খালের ধার দিয়ে একটা সরু পথ স্কুলের দিকে গেছে। দু'পাশের ঝোপ থেকে ভেসে আসছে বনফুলের গন্ধ। ভিন্ন মাত্রার নান্দনিকতায় ভরে আছে সাথীর মন।সরু গ্রামীণ পথ দিয়ে সাথী পৌঁছে যায় স্কুলে। ইদানিং এই স্কুলকে ঘিরে তার একটা স্বপ্নের বুনন চলছে। স্কুলের নাম শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের ডলি ম্যাডাম তার ব্যাথাতুর শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলছে আনন্দে - আকাশে-বাতাসে সে দেখছে ডলি আপার মুখ। শিশুমনের চঞ্চলতাকে কেমন করে ডলি আপা বাঁধলো, তা রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখে। শুধু এতটুকু জানা যায় ডলি আপা শিশুদের বর্ণপরিচয় শেখায়, গণিত শেখায়। গান-ছড়া গেয়ে শোনায় - শেখানোটা তার খেলতে খেলতে, গাইতে গাইতে আর গল্পে-গল্পে। ডলি আপা শিশুদের চোখের দিকে তাকান, নিবিড় করে স্পর্শ করে আদরে- সোহাগে আপন করে নেন। অল্পদিনের এই নিবিড় সান্নিধ্যে একটা বন্ধন তৈরি হয় - সে বন্ধন গভীর আবেগীয় বন্ধন।তার নিজেরও এক মেয়ে এই স্কুলে পড়ছে - নাম তার নিশি। নিশি এখন প্রথম শ্রেণির ছাত্রী।

আজ সাথী শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে দেখে অনেকগুলো বর্ণকার্ড ছড়ানো মেঝেতে। আঁকাজোকা শেখার পেন্সিল, রঙিন কাগজ। একটা বর্ণ কার্ডে লেখা "মা"। সাথী বর্ণকার্ডটা নিয়ে ম্যাডামের দিকে মেলে ধরে; ম্যাডাম বলে ওঠে "মা"। সাথী "মা" শব্দটা পড়তে পড়তে ডলি আপার কাছে চলে যায়; আপা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় - ভালোবেসে বলে, "হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোমার মা। সাথী আনন্দে ডলি আপাকে জড়িয়ে ধরে"।

নিশির ক্লাসে শিক্ষক ছিল না। বেঞ্চে বসা নিয়ে পাশের সহপাঠীর সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়, ধাক্কাধাক্কি হয়। নিশি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে চলে আসে। এসে তার চোখ আটকে যায় - একটা শিশু তার মায়ের কোলে পরম আদরে স্থান করে নিয়েছে। মা তাকে ঠিক তারই মতো ভালোবেসে মমতায় জড়িয়ে ধরে আছে। মা নিশির আজীবনের সম্পত্তি। একজন নবাগত কোথা থেকে এসে দখল করে বসে আছে। নিশি কিছু না বলেই মা'কে দখলমুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগল। কোল থেকে ছিনিয়ে নিতে শিশুটির হাত ধরে দিল হ্যাচকা টান এবং মা'কে জাপটে ধরলো - এ যেন এক বীর-কন্যার রাজ্য পুনরুদ্ধার।

ডলি আপা দু'জনকেই স্নেহ বন্টন করতে চাচ্ছিল কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে কৌশল অবলম্বন করল। নতুন উদ্যোমে পড়াতে শুরু করলো -
"তিন এর পরে চার
আর চার এর পরে পাঁচ,
এমনি করে গুণতে পারি
ফুল, পাখি আর গাছ।"...

ছড়া পাঠ শেষ হতে না হতেই ছেলেমেয়েদের স্কুলের ফুল বাগানে নিয়ে গেল। বাগানে ফুটে আছে গোলাপ, বেলী, জুঁই।

- এই গাছটিতে কয়টি গোলাপ তোমরা গুনতে পারবে?

- জ্বি,আপা।

- বলো দেখি?

এমনি কিছু সংলাপে নিশির ক্রোধ মিলিয়ে গেল।

প্রারম্ভিক শিশুদের আনন্দদানের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই ডলি আপার। তার কণ্ঠে একটা মাধুর্য আছে, চোখে একটা মায়া আছে - সেই মায়ার বাঁধনে আটকা পড়ে আছে সাথী, সবুজ, রজনী, রেখার মতো ত্রিশ জন বালক-বালিকা।

স্কুল ছুটির পর নিশি মায়ের সাথে বাড়িতে ফিরছে। সহসা নিশি বলে, "মা, সাথী খুব পচা"। মা'কে জাপটে ধরে নিশি বলে, "তুমি আমার মা, ওর না। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। একটা পুরাতন বিড়ম্বনার কথা মনে পড়ে ডলি আপার শরীর-মন ছ্যাত করে জ্বলে উঠল। সে বছর পনেরো আগের কথা। তখন ডলি আপা ফরিদপুর সানরাইজ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকা। একঝাঁক নবীন শিক্ষার্থীদের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে মাহিদা পারভীন ডলি। তার মাতৃস্নেহের প্রাবল্যে আটকে যায় কোমলমতি শিশুদের দল। আজকের মতো সঙ্কটকাল এসেছিল তখনও। তাদের 'মা' ডাক শুনে ডলি আপার প্রথম কন্যা ঈর্ষান্বিত হতে হতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আপন সন্তানের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল ডলি আপা। সে দফা ডলি আপা শিশু মনোবিজ্ঞানের বই পড়তে শুরু করে। ফ্রয়েডের ইডিপাস আর ওডিপাস কমপ্লেক্সও অধ্যয়ন করেছিল মন দিয়ে। মনে হয়েছিল, শিশুমন যুগপৎ সরল ও জটিল; নিজের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কিছুটা অনুদার হতে হয়েছিল তাকে।

আজ মাহিদা পারভীন ডলি স্কুল থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথের 'সঞ্চয়িতা' পড়ছিল।

"এক কক্ষে ভাই লয়ে, অন্য কক্ষে ছাগ,
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ।
পশুশিশু, নরশিশু, দিদি মাঝে পড়ে
দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয় ডোরে।"

পঙক্তিটি পড়তে পড়তে মনে হল ফর্মুলাটা প্রয়োগ করে দেখা যায়।

আপন শিশু আর অন্যের শিশুকে সমান সোহাগ দিতে চায় ডলি আপা।এর বিবিধ উপায় মনে আঁকতে আঁকতে স্কুলে প্রবেশ করছে সে। সাথে শিশুকন্যা নিশি। স্কুলের প্রবেশপথে ডলি আপাকে দেখে দৌঁড়ে এসে মা-মা বলে জড়িয়ে ধরল সাথী। শুরু হল দুই শিশুর যুদ্ধ - দুজনেই ডলি আপাকে দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠল। নিশির এক ধাক্কায় পড়ে গেল সাথী। সাথী জীর্ণ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ডলি আপার দিকে চেয়ে রইল।

অনেকদিন হতে চলল। সাথী এখন আর ডলি আপাকে 'মা' বলে ডাকে না। আগের মতো দেওয়াল ঘেঁসে বসে থাকে সে।

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।