গল্প ও অণুগল্প

আমার মা (অষ্টাদশ পর্ব) [ধারাবাহিক উপন্যাস]



অচিন্ত্য সাহা


স্কুলে নিযুক্ত হয়ে বেশ ভালো লাগলো। শরীরে শীতল উত্তাপ অনুভব করলাম। বুকের মধ্যে এতদিন যে পাথরটা চাপা ছিল সেটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল একঝাঁক কচি-কাঁচাদের সরল ও নিষ্পাপ হাসিতে। মনের গভীরে লালিত স্বপ্নগুলো এবার বাস্তব রূপ পাবে। বাবাকে দেওয়া কথাগুলো আমাকে পূর্ণ করতে হবে। যে গুরুদায়িত্ব তিনি অর্পণ করেছেন তাকে সম্পন্ন করতে গেলে একা একা কখনোই সম্ভব নয়। তাই এমন কোনো সংগঠন বা সংস্থার প্রয়োজন যার মাধ্যমে আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করা যায়। সমাজের জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারার কারণ আগে অনুসন্ধান করতে হবে। তার জন্য প্রচুর পড়াশোনার প্রয়োজন। কৃষ্ণনগরে যে সমস্ত পাঠভবন আছে সেখানে মনের মতো বই পাওয়া যায় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার মধ্যে অনেক রসদ আছে কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণতা নেই। দরকার সমাজবিজ্ঞানের তথ্যসমৃদ্ধ বই, বিশ্লেষণ মূলক প্রবন্ধ। কলেজে পড়ার সময় আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক কুমুদ বাবু গোঁড়া বামপন্থী মানুষ। তিনি বলতেন - রাষ্ট্র হলো শ্রেণি শোষণের যন্ত্র। শ্রেণী সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেছেন - দ্বন্দ্ব মূলক বস্তুবাদের কথা। এসব বিষয়গুলো ঠিকঠাক বুঝতে গেলে এমন একজনকে দরকার এ বিষয়ে যাঁর জ্ঞান অসামান্য। শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না, যিনি এগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করেন। এই মুহূর্তে যাঁর নাম মনে আসছে তিনি হলেন বাসবদা। বাসবদা ছিলেন কলেজে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতা। বর্তমানে তিনি বামপন্থী সংগঠন ছেড়ে কী একটা নতুন সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তার জন্য তিনি তাঁর মোটা মাইনের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতে কেউ কেউ আপত্তি করলেও পরে তাঁরা বুঝেছেন যে, বাসবকে আটকানোটা ঠিক হবে না, ও যে পথে চলতে চায় সেই পথেই চলুক। নাহলে ওর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বিঘ্নিত হবে। বাসবদা তার পর থেকে গ্রামে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে পড়ে আছেন। কখন কোন গ্রামে থাকেন কেউ বলতে পারে না। ওনার প্রথম লক্ষ্যই হলো - গ্রামজীবন নিয়ে পড়াশোনা করা। ওদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে না পারলে কিছুই শেখা যাবে না। বর্তমানে মুর্শিদাবাদের কোন একটা গ্রামে আছেন। বাসবদা ভালো গান লেখেন, তাতে সুর দিয়ে গান বেঁধে ফেলেন। সারাদিনের কাজের পর সবাই যখন ঘরে ফিরে বিশ্রাম নেয় তখন বাসবদা একাকী খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে গান লেখেন অথবা নাটক লিখে চিৎকার করে সংলাপগুলো আওড়ে যান। প্রথম প্রথম কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করলেও পরে যখন তাঁরা তাঁর সংস্পর্শে আসেন তখন তাঁদের ধারণা আমূল পাল্টে যায়। তাঁরা একজন প্রকৃত দরদী মানুষকে খুঁজে পান - বাসবদার মধ্যে। এভাবে তাঁর প্রভাবে তাঁরা যখন তাঁদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে তখন বাসবদা তাঁদের অধিকার আদায়-এর পথ দেখিয়ে আবার “অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে” ছুটে চলে যান - এভাবেই তিনি ঘুরে বেড়ান এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। মানুষকে জাগানোর গান শোনান।

বাসবদার বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম তিনি কোথায় আছেন। রবিবার ও ছুটির দিনগুলোতে আগের মতোই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। চাকরি পাওয়ার পর এই নিয়মের কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছে বটে তবে বাইরের টান কোনোভাবেই হারিয়ে যায়নি। দুদিনের ছুটি পেয়ে বাসবদার টানে বেরিয়ে পড়লাম। বেথুয়াডহরী থেকে পাটিকাবাড়ির দিকে যে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে দেখলাম একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছেন। কী ঘটেছে জানার জন্য কৌতূহল দমন করতে না পেরে এগিয়ে গেলাম। ওরা তখন একটা অল্পবয়সী মেয়েকে ঘিরে কীসব আলোচনা করছে। একটু এগিয়ে যেতেই বুঝলাম মেয়েটিকে সাপে কেটেছে আর গ্রামের একজন লাল রঙের কাপড়ে আবৃত গলায় একগুচ্ছ রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল টিপ দেওয়া আঁকাবাঁকা ছড়ি হাতে, হয়তো কোনো গাছের ডালকে কেটে সুকৌশলে এমন আকার দেওয়া হয়েছে সেই ডালটি হাতে নিয়ে নিখুঁত অভিনয়ে সাপের গুষ্ঠির ষষ্ঠী পুজো করছে। মেয়েটিকে মাটিতে শুইয়ে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওই অদ্ভুত দর্শন লাঠি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে আর বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র উচ্চারণ করছে এদিকে মেয়েটি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সারা শরীর তখন নীলবর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। সেদিকে লাল কাপড়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি আমার দ্বিচক্রযানটিকে রেখে ওদের কাছে গিয়ে সবাইকে বললাম - মেয়েটিকে খরিষে কেটেছে এক্ষুনি দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যান নাহলে ওকে বাঁচানো যাবে না। বিষধর সাপে কাটলে তাকে বাঁচানোর ক্ষমতা ওঝার নেই। উপস্থিত বয়স্কদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কথার সমর্থনে রাজি হলেন। তখন কয়েকজন অল্পবয়সী যুবক এগিয়ে এসে একটা টলি ভ্যানে মেয়েটাকে চাপিয়ে ছুটলো বেথুয়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। লাল কাপুড়ে ওঝাটি তখন আমার দিকে রক্তচক্ষুর অভিশাপ বর্ষণ করছে। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে তখন সাপের বিষয়ে আমার জানা কথাগুলি বললাম। প্রসঙ্গত জানাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের নবম দশম শ্রেণির ছাত্রদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলি বললাম। ওরা সবাই মন দিয়ে শুনলেন। সাপে কাটলে কী কী করণীয় সেটাও ওদের জানিয়ে দিলাম। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই খবর এলো - মেয়েটি অনেকটা ভালো আছে।

সবাই তখন এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার আরও কাছে এগিয়ে এলো। ততক্ষণে লাল কাপুড়ে রেগেমেগে আরও লাল হয়ে গেছে। আমি তার বাড়া ভাতে জল ঢেলে দিয়েছি। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললো - আপনি কে মশাই, এখুনি এখান থেকে বিদেয় হন। আমাদের গ্রামীণ সমাজের বিষয় নিয়ে আপনাকে নাক গলাতে কে বলেছে। জানেন আমি আজ চল্লিশ বছর ধরে এই জীবিকাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছি। আজ পর্যন্ত কেউ আমার ক্ষমতা নিয়ে কথা বলেনি আর আপনি -

- হ্যাঁ, আমি। আপনি গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ঠকিয়ে, তাঁদেরকে ভুল বুঝিয়ে ভুল পথে চালনা করবেন সেটা সচক্ষে দেখে আমি মেনে নেবো? তা কোনোভাবেই হবে না। বরং আপনি সঠিক জিনিস নিয়ে বিজ্ঞান সম্মতভাবে চর্চা করুন তাতে আপনার রোজগার কম হলেও মানুষ আপনাকে মাথায় করে রাখবে।

উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে এলো - আরে ইনি তো সঠিক কথাই বলেছেন। ওনার ওপর ভরসা করে চল্লিশ বছর ধরে অনেক মানুষ অকালে চলে গেছেন। এই লাল কাপুড়ে যে কত লোকের সর্বনাশ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এ-ব্যাপারে আমরা তো কখনও তলিয়ে ভাবিনি।

সবাই একসাথে চিৎকার করে বললো - হ্যাঁ উনি ঠিক কথাই বলেছেন।

লাল কাপুড়ে বুঝতে পেরেছে গতিক সুবিধাজনক নয়। এখনই এখান থেকে সরে না পড়লে বিপদ বাড়তে পারে। সে একছুটে আমার কাছে এসে বললো - আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমি এখন থেকে এইসব কাজ আর করবো না। জানেন আমার এই অপকর্মে উপার্জিত অর্থ আমার কোনো কাজে লাগে না। আমার একমাত্র কন্যা সোনিয়া লিভারের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবো তার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। আপনি একবার চলুন না আমার বাড়িতে - নিজে চোখে দেখে আসবেন।

আমি কোনো আপত্তি করলাম না। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি তো এই কারণেই। গ্রাম জীবনকে ভালোভাবে জানা, বোঝা, তাকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে না পারলে সমাজের জীর্ণ দশার কথা অন্তরকে স্পর্শ করবে কীভাবে? ওঝার নাম নরেন বিশ্বাস। ওর মেয়ের নাম রিতু। বছর তিনেক আগে ওর মা মারা গেছে। গ্রামের একজন বয়স্ক মহিলা নরেন ওঝার বাড়ির কাজকর্ম করে দেয়। নরেন ওকে ওর পারিশ্রমিক দিতে পারে না শুধু সারাদিনের খাবারটা দেয়। দেয় বলাটা ঠিক হবে না, উনি নিজের হাতে নরেন ও তার মেয়েকে খাইয়ে তারপর নিজে নিজেই খাবার খেয়ে নেয়। রাতে বাড়ি ফেরার সময় ওদের জন্য খাবার রেখে নিজের মতো খাবার নিয়ে চলে যায়। রিতুর বয়স যখন সাত বছর তখন ওর রোগটা ধরা পড়ে। স্থানীয় একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি বললেন - ওর লিভারের সমস্যা আছে। এটা যেমন তেমন রোগ নয়। আমাদের দেশে খুব কম মানুষেরই এই রকম রোগ আছে। এটা এমনই এক দুরারোগ্য ব্যাধি যা সহজে নিরাময় হয় না। তবে এটা একটা ব্যয়বহুল চিকিৎসা, সাধারণ আটপৌরে মানুষের পক্ষে এ চিকিৎসা চালানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।

নরেন ওঝার বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। চারপাশ ঘুরে ঘুরে যা দেখলাম তাতে আমার মাধব কাকার কথা মনে পড়ে গেল। মাধব কাকার বাড়িটাও ঠিক এমনই ছিল। মাঝখানে ছোটো একটা উঠোন তাকে ঘিরে চারদিকে চারখানি ঘর। দু’খানা নরেনের এবং বাকি দু’খানা ওর কাকার ছেলেদের। কাকা দীর্ঘদিন আগে দুই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন। খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর দু’খানার জীর্ণ দশা দেখে আমার বড্ড খারাপ লাগলো। গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে গাছগাছড়া, শিকড় বাকড়, তাগা তাবিজ, মাদুলি বিক্রি করে এবং ঝাড়ফুঁক করে যৎসামান্য উপার্জন করে টেনেটুনে সংসার চালায়। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসাও করে। এ পর্যন্ত যত সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেছে তার মধ্যে বেশির ভাগই নির্বিষ সাপে কাটা রোগী। বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেছে কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারেনি। সেক্ষেত্রে ওকে বলতে হয়েছে - বাবা সকল ওর পরমায়ু ওই পর্যন্তই ছিল তাই বাঁচেনি।

আমি রিতুকে দেখার পর বললাম - নরেন তুমি তোমার মেয়েকে কলকাতায় এসএসকেএম-এ নিয়ে যাও। ওখানে ভালো ভালো ডাক্তার বাবুরা আছেন। ওখানে দেখালে তোমার মেয়ের সঠিক চিকিৎসা হবে। খরচও খুব বেশি নয়। ওখানে বিনামূল্যে ওষুধও পেতে পারো।

নরেনের হাতে একশো টাকার পাঁচটা নোট দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে চললাম আমার গন্তব্যের দিকে।

(ক্রমশ)