গল্প ও অণুগল্প

মা হওয়া



পিয়ালী রায়


কাল স্কুল থেকে ফেরার পর একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে দীঘি। বিকেলে অন্যদিনের মতো পাশের ফ্ল্যাটের আলতার সাথে খেলতেও গেল না। সন্ধ্যেয় অফিস থেকে ফিরে মেয়ের এই অবস্থা দেখে সুনেত্রা বর্ষাকে দীঘির কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে বর্ষাও কিছু উত্তর দিতে পারল না। রাতে বর্ষা ও সুনেত্রার শত অনুরোধ উপরোধেও দীঘি খাবারের একদানাও মুখে তুলল না। পরের দিন মেয়ে স্কুল যেতে না চাইলে সুনেত্রা আর জোর করল না। কান্না থামলেও মেয়ে এখনও পর্যন্ত একটা কথাও সুনেত্রা বা বর্ষা কারও সাথেই বলেনি। সুনেত্রা চিন্তিত গলায় বর্ষাকে বলে, "কি হল বল তো? আমার তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দিনকাল যা পড়েছে, কেউ কিছু করল না তো!" বর্ষা সুনেত্রার হাতে হাত রেখে বলে "চিন্তা করিস না। তুই অফিসে যা, আমি দেখছি কি করা যায়।"

দীঘির সামান্য কিছু হলেই সুনেত্রা অস্থির হয়ে ওঠে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দীঘিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল সুনেত্রা। জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আজ যখন একটু সুখের মুখ দেখেছে ঠিক তখনই দীঘির চোখের জল ওকে বিহ্বল করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই আর পাঁচটা মেয়ের থেকে সুনেত্রা আলাদা। বরাবর ভালো রেজাল্ট করলেও ভীষণ দুষ্টু আর ডানপিটে ছিল। স্কুলের টিফিন ব্রেকে অন্য মেয়েরা যখন বসে বসে গল্প করছে বা ফ্লাইং ডিস্ক খেলছে, ও তখন ছেলেদের সাথে চুটিয়ে ফুটবল খেলতে ব্যস্ত। স্কুলে থাকতেই মিউজিক ক্লাসে ড্রামস বাজানো শিখল। মেয়েদের মধ্যে এমন ভালো ড্রামার প্রায় দেখাই যায় না। ড্রামসে ওর প্রতিভা দেখে ওদের স্কুলের মিউজিক টিচার মিস্টার রডরিকস সুনেত্রাকে ওই বয়সেই বাইরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু কি যে হল ইলেভেনে উঠে হঠাৎ বিয়ে করে বসল। স্কুল আসা যাওয়ার পথে প্রেম, তারপর পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। একমাত্র মেয়ের এ-হেন আচরণে মা-বাবা ভেঙে পড়লেন। সুনেত্রাকে ঘিরে তাঁদের কত স্বপ্ন ছিল! তবে সবচেয়ে হতবাক ওর বন্ধুরা। সুনেত্রা আর বিয়ে! এও কি সম্ভব! লোকনিন্দা ও মেয়ের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মা-বাবাও মুখে কুলুপ আঁটলেন। দেড় বছরের মাথায় ফিরে এল সুনেত্রা মা-বাবার কাছে, বরের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। কিন্তু ততদিনে পেটে বাসা বেঁধেছে আরেকজন। সুনেত্রা ও অনাগতের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা-বাবা চেয়েছিলেন গর্ভপাত করানোর জন্য, কিন্তু ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

বাচ্চা জন্মানোর পর সুনেত্রা আবার স্কুলে ভর্তি হল। সেখান থেকে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চাকরী-পরীক্ষার বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে অবশেষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই সরকারী চাকরীতে প্রবেশ। লেখাপড়ার পাশাপাশি ড্রামসের অনুশীলনে কোনো ছেদ ঘটেনি। চাকরি পাওয়ার বছর দুয়েক-এর মধ্যেই মা-বাবার বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসে সুনেত্রা। বাড়ির কাছাকাছি ফ্ল্যাট হওয়ায় মা-বাবার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করলেও স্বাধীনভাবে মেয়েকে বড় করবে বলেই এই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত।

সুনেত্রা এখনও বিভিন্ন মিউজিকাল ব্যান্ডের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পায়। চাকরী সামলে সব অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হলেও অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই সে পারফর্ম করার চেষ্টা করে। এমনই এক অনুষ্ঠানে বর্ষার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। বর্ষার লয়-জ্ঞান ও সুর দক্ষতায় মুগ্ধ হয় সুনেত্রা। সমবয়সী হওয়ায় খুব অল্পদিনের মধ্যেই পরিচয় গাঢ়-বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বর্ষার বাবা অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মী, বাড়িতে আর আছেন মা ও দাদা-বৌদি। দাদা-বৌদি দু’জনেই নামজাদা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বর্ষা ছোট থেকেই মেধাবী কিন্তু কোনো কাজে বেশী দিন লেগে থাকা ওর ধাতে নেই। ছোট থেকে সহজাত সুরদক্ষতা দেখে মা-বাবা গান শেখাতে শুরু করেন। ভালোই চলছিল গানের তালিম; বাড়ির সবাই চেয়েছিল বর্ষা গান নিয়েই থাকুক কিন্তু হঠাৎ করে বলে বসল, সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। একগাদা টাকা খরচ করে ভর্তিও হ’ল কোচিং সেন্টারে। কিন্তু ওই যে চঞ্চলমতি, না করল পড়াশোনা, না করল ঠিকঠাক গান। সুনেত্রার সাথে পরিচয় এমনই ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছিয়ে গেল যে একসময় বর্ষা নিজের বাড়ি ছেড়ে উঠে এল সুনেত্রার ফ্ল্যাটে। একটা ছোট হোম স্টুডিও বানিয়ে গানবাজনার নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় মেতে ওঠে।

পোশাক আশাক, হাবভাবে সুনেত্রা বেশিটাই পুরুষালি। ছেলেদের মত উদ্দাম গতিতে বাইক চালায়। হঠাৎ করে দেখলে ওকে মেয়ে বলে চেনা দায়। বর্ষাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে একসাথে যখন কোন অনুষ্ঠানে যায়; অনেকেই ওদের নিয়ে হাসাহাসি করে। বলে এলেন স্বামী-স্ত্রী।

সুনেত্রার বিয়েটা একটা অল্প বয়সের মোহ বা জৈবিক তাড়না। বিয়ের মাস ছ’য়েক যেতে না যেতেই দিব্য মানে ওর স্বামীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক টানটা কেমন যেন কমতে থাকে। দিব্যও তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। যে ছটফটে মিষ্টি মেয়েটা ওকে আকর্ষণ করতো সেই মেয়েটা কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠতে লাগল। নারীসুলভ কমনীয়তা কমতে লাগল সুনেত্রার মধ্যে। সুনেত্রা ও দিব্যর পারস্পরিক মোহভঙ্গে দিব্যর বাবা-মা ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এতদিন ছেলের জেদের জন্য কিছু করতে পারেন নি। সুনেত্রা ফিরে যেতে চাইলে তারাও আর বাধা দেননি। আসলে দিব্যর সাথে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার পর সুনেত্রা অনুভব করে পুরুষ শরীরের প্রতি তার তেমন কোনো আকর্ষণ নেই।

আজ অফিসে গিয়ে সারাদিন কাজে মন বসাতে পারেনি সুনেত্রা। বর্ষাকে দু’তিনবার ফোন করে মেয়ের খবর নিয়েছে। অনলাইনে চাইল্ড কেয়ার লিভের এপ্লিকেশন করল সুনেত্রা। মেয়ের পছন্দের চিকেন বিরিয়ানি, আইসক্রীম নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। অন্যদিন ডোরবেল বাজলে দীঘিই লাফাতে লাফাতে দরজা খোলে, কিন্তু আজ তার অন্যথা ঘটল। বর্ষা এসে দরজা খুলল। চোখের ইশারায় সুনেত্রা জানতে চাইল দীঘির কথা; বর্ষাও ইশারায় দেখাল যে ল্যাপটপে মন দিয়ে গেম খেলছে। সুনেত্রা ঘরে ঢুকে মেয়ের মাথায় হাত রাখল। দীঘি হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল। সুনেত্রা আবার চেয়ারের পেছন থেকে গলা জড়িয়ে আদর করতে গেলেও হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। রাতেরবেলা খাবার টেবিলে বর্ষা দীঘিকে ডাকে, "দীঘি খেতে আয়। দেখ তোর ফেভরিট চিকেন বিরিয়ানি।" দীঘি চটপট খেতে বসে গেল। সুনেত্রা টেবিলে আসার আগেই ওর খাওয়া শেষ। বিরিয়ানি শেষ করে এখন মন দিয়ে আইসক্রীম খেতে খেতে কার্টুন দেখছে। ডাইনিং টেবিলে বর্ষা আর সুনেত্রা। বর্ষা সুনেত্রাকে আজ সারাদিনের যাবতীয় ঘটনার বিবরণ বলতে থাকে। সুনেত্রা বলে, "চল ক'দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসি। বর্ষা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে, "তোর অফিস ?”

"সিসিএল-এর অ্যাপ্লাই করেছি। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে।"

"তাহলে তো কোথায় যাব, কিসে যাব, হোটেল বুকিং এসবের ব্যাপার তাড়াতাড়ি করতে হবে।"

সুনেত্রা বলে, "কাছাকাছির মধ্যে সামথার ভালো জায়গা। আমাদের সাথে পড়ত পিনাকী, ওর একটা কটেজ আছে ওখানে। দেখি, যদি খালি থাকে ওইসময়।"

বর্ষা বলে, "এত তাড়াতাড়ি ট্রেনের টিকিট তো পাওয়া যাবেনা।"

সুনেত্রা - "ট্রেনের তো প্রশ্নই নেই। এখন টয়লেট-সহ ভালো ভালো বাস শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাচ্ছে। ওরই একটা টিকিট অনলাইনে বুক করে রাখ।"

বর্ষা - "দীঘি এতটা বাস জার্নি করতে পারবে তো?"

সুনেত্রা, "না না। ও পারে। এর আগেও বাস জার্নি করেছে।"

বর্ষা - "তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই।"

বিছানায় শুতে এসে দেখে দীঘি ঘুমিয়ে কাদা। সুনেত্রা ওর মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। টিউবলাইট নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বালিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। মাঝরাতে হঠাৎ দীঘি কি একটা স্বপ্ন দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মা'কে জড়িয়ে ধরে। সুনেত্রাও জড়িয়ে ধরে মেয়েকে।

"এই তো বাবু আমি আছি। কি হয়েছে তোমার? বলো কি হয়েছে!"

দীঘির চোখের জলে সুনেত্রার বুক ভেসে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, "ওরা সবসময় তোমাকে নিয়ে আমায় কথা শোনায়। বলে ওটা তোর মা না বাবা? সবার মায়েরা কি সুন্দর সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি এসব পরে আসে, লম্বা চুল। আর তোমার চুল ছেলেদের মতো, বড় বাইক চালাও; সবাই আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে। সত্যি করে বল, তুমি আমার বাবা না মা!

আত্মজার প্রশ্নে সুনেত্রা প্রস্তরবৎ। যে প্রশ্নের উত্তর সে এতবছর ধরে খুঁজে এসেছে, যার উত্তর তার নিজের কাছেই নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর সে কেমন করে দেবে?

চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।