কুপন নং. ১৫১৯৩৭
নম্বরটা পড়ে হামিদ পুরো টিকিটের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে কাউন্টার ক্লার্ককে বলল,
- ছার, ৩৭ ক্যান? ৪০ দেন। মনে রাকতি কষ্ট হইয়ি যাবেনে। এইটা বদলায়ি দেন।
- কি বলেন ভাই! ছেঁড়া টিকিট চেঞ্জ করে দেবো কিভাবে? নাম্বার মিলিয়ে কি আর টিকিট বিক্রি হয়! আপনাকে ৪০ দেব, আর একজনকে ৫০ দেব, আর মাঝের টিকিটগুলো নেবে কারা?
- বদলায়ি দিলি একটু সুবিধে হইতু, এই আর-কি। এইটা আরেকজনকে দিতেন। টিকিট-ই তো; এতো আর খাওনের জিনিস না-যে এঁটো হইয়ি গিচে।
- এই ভাই, মাথা গরম কইরেন না তো। কোনো চেঞ্জ হবে না। পছন্দ না হলে ফেলে দিয়েন বাইরে গিয়ে। সাইড দেন। পরের জনকে আসতে দেন। যান।
- আইচ্চা ভাই, যাচ্চি। একটু সুবিদের জন্যি বুলচিলাম আর-কি। কিচু মনে কইরেন না। গেলাম।
- আরে ভাই, টাকাটা তো দিয়ে যান। পঞ্চাশ টাকা।
- ওহ্ হ্যা হ্যা। নেন ধরেন, ভাই। কপালে থাকলি হয়! ১৫১৯৩৭, ১৫১৯৩৭...। যদি লাইগা যায়।” – আপন মনে আওড়াতে আওড়াতে হামিদ কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এল। তারপর দশ-বারো পা হাঁটার পর তার মাথায় হঠাৎ একটা নতুন খেয়াল এল। সে কপাল চাপড়ে বেশ জোরে করেই বলে উঠল,
- হায় আল্লাহ্, বুদ্দিটা কেন যে আগে আইল না! আর তিনটে কিইনে নিতাম, চল্লিশ পুইজি যাইতু। মনেও থাইকতু আর চান্স বেশি হইতু। দুর!
হামিদ পকেটে হাত দিলো টাকা দেখার জন্য। ছেঁড়া মলিন লুঙ্গির কোমরের ভাঁজ খুলে সে চারটা পাঁচ টাকার নোট, আটটা দুই টাকার নোট, তিনটা দশ টাকার নোট ও একটা বিশ টাকার নোট বের করে গুনে দেখল মোট ছিআশি টাকা। তারপর সে জামার গলার দিক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ভেতরকার গুপ্ত পকেট থেকে আরও কিছু বড় টাকার নোট বের করে আনল। চারপাশটা দেখে নিয়ে সে কিছুদূর হেঁটে তার রিক্সার পাশে একটা গাছের নিচে বসল। এবার সে তার পরের
টাকাগুলো গুনতে শুরু করল। সবগুলো মিলে দেখল তার কাছে মোট দুইশত ছিয়াশি টাকা আছে। সে পঞ্চাশ টাকা লুঙ্গির ভাঁজে গুঁজে রেখে বাকি টাকা ভেতরের পকেটে লুকিয়ে রাখল।
এরপর সে টিকিটটা অতি যত্ন সহকারে বিনা ভাঁজে ভেতরের পকেটে রেখে দিলো। কাউন্টারের মুখে যাত্রীর আশায় দাঁড়িয়ে রইল সে। বেশকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে একজন যুবককে পেল যাত্রী হিসেবে। যুবক উঠে বসতেই সে রিক্সা চালানো শুরু করল।
- কোন্ দিক ছার?
- তোমার কি কোনো কাজ আছে আজ? মানে আজ সারাদিন আমার এক বন্ধুকে নিয়ে পুরো এলাকা ঘুরতে হবে। পারবে? না-কি অন্য রিক্সা দেখবো?
- না না ভাই, কোনো সমস্যা নাই। আপনের বন্দুকে কই থেইক্যা তুলবেন?
- দাঁড়াও, দেখি ফোন দিয়ে।
যুবকটি ফোন দিয়ে হামিদকে জানালো পনেরো মিনিট লাগবে তার। তাকে স্ট্যান্ড থেকে তুলতে হবে। হামিদ তাকে জানালো যে তার একবার বাড়ি যেতে হবে।
- কতদূর বাড়ি তোমার? টাইমের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে তো?
- ছার, আপনে রিক্সায় থাকেন। পাঁচ মিনিটের পথ মাত্র এখান থেইক্যা। আপনি একা আর দাড়াইবেন কৈ! চলেন ঘুইরাই আসি।
হামিদ তাকে নিয়ে বাড়ির পথে চলল। সে যুবকের সাথে কথা বলে তার একঘেয়েমি কাটাতে চাইল।
- বলি ভাই, টিকিট তো নিছেন। তাই না?
- হুম।
- আমিও নিছি একটা। পঞ্চাশ টেকা দাম। ইচ্ছা হইল চারডা নি। তা পারলাম না। আর লোকটার ব্যাবহারডাও ভাল্লাগলো না। কত করে বললাম যে সাঁইত্রিশ না, চল্লিশ দেন- তা ধমকি দিল আবার!
হঠাৎ হেসে নিজেই বলল,
- যাক মনে আছে দেকচি! লোকটা ধমকি দিয়া নাম্বার মুকস্তো করাই দিছে।
কথাগুলো বলে সে নিজেই কিছুক্ষণ হাসল। তারপর যুবককে উদ্দেশ্য করে বলল,
- আপনেকে কত নাম্বার দিছে?
- তুমি রিক্সা চালাও।
- অ-আইচ্চা।
অল্প সময়ের মধ্যেই হামিদ বাড়ি পৌঁছে গেল। সে রিক্সার বেলটা বাজাতেই দুইটা ছোট মেয়ে দৌঁড়ে বের হয়ে এল। আগন্তুক দেখে বয়সে একটু বড় মেয়েটা যত দ্রুত সম্ভব পিছিয়ে ভেতরে চলে গেল আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছোট বোন আর বাবাকে দেখতে লাগল। হামিদ ভেতরের পকেট থেকে টাকা বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বলল,
- তোর মাকে দিস।
মেয়েটা চলে যেতে গেলে হামিদ আবার তাকে দাঁড় করিয়ে টিকিটটা তার হাতে দিয়ে বলল,
- যত্ন করে রাখিস মা। যা।
হামিদ আবার রিক্সায় ফিরে এল। সে যুবককে আর তার বন্ধুকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল। টাকাগুলো পেয়ে সে খুশি মনে ভাবল সেটা দিয়ে ছেলের স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে পারবে। হঠাৎ বউ রেগেমেগে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকে টিকিটটা তার সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
- অভাবের সংসারে সপ্তায় সপ্তায় টাকা দিয়া কাগজের একখান কইরে টুকরো না কিনলি হয় না? জীবনে তো কম কিনলা না, কোনোদিন কি কিচু পাইছো যে এর পিছনে এত্ত খরচ কর? টাকা কয়ডা হলি দুই কেজি চাল হইতু। কবে হুস হবে তুমার?
হামিদ অনেক কষ্টে রাগ চাপা দিয়ে চুপ করেই রইল। রাগ দেখানো শেষ হলে বউ ঘর থেকে বের হয়ে গেলে পড়ে থাকা টিকিটটা হামিদ তুলে নিয়ে তা ছেলেকে দিল পড়তে।
- দেখ তো বাবা পিরাইজ কি কি আছে?
- প্রথম পুরস্কার পাঁচ লক্ষ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার তিন লক্ষ টাকা আর তৃতীয় পুরস্কার এক লক্ষ টাকা।
- খেলা কবে?
- ডিসেম্বরের আঠারো তারিকে, আব্বা।
- অ-আচ্ছা, যা তুই।
পরবর্তী এক সপ্তাহ যথা নিয়মেই চলল হামিদের। ড্র-এর আগের সারাটা রাত হামিদ এটা-ওটা কল্পনা করে কাটালো।
আঠারো তারিখ সকাল হতে না হতেই সে রিক্সা নিয়ে বের হয়ে গেল টিকিট সঙ্গে নিয়ে। কাউন্টারের একটু দূরে রিক্সা থামিয়ে সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ভেতরে প্রবেশ করে দেখল মোটামুটি ভালোই ভিড় জমে আছে। ঘোষণা আগেই সমাপ্ত হয়ে গেছে। যে যার প্রাইজ নিয়ে চলে গেছে। এখানে যারা আছে সবাই হামিদের মত দেরিতে পৌঁছেছে। একরকম শোরগোল হচ্ছে সেখানে। হামিদ তার টিকিটটা নিয়ে সোজা সামনের অফিসে গিয়ে দেখিয়ে বলল,
- হইনিতো ভাই, না?
নম্বরটা দেখেই লোকটি বলল,
- আপনিই তো প্রথম পুরস্কারটি জিতেছেন। কোথায় ছিলেন আপনি এতক্ষণ? কতবার করে ডেকেছি জানেন!
হামিদ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কথাগুলো শুনেই যাচ্ছিল। লোকটি তার হাতে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিল। অফিসের সবাই মিলে ছবি তুলল তার সাথে। এতক্ষণেও হামিদ সম্পূর্ণ নীরব। তাকে ঘিরে সব আনুষ্ঠানিকতার পর্ব শেষ হলে সে ধীর পায়ে কাউন্টারের বাইরে এল। বাইরে এসেই হঠাৎ তার চিন্তাধারা স্বাভাবিক হয়ে এল। সে চেকটি হাতে নিয়ে বহুবার চুমো খেয়ে সেটিকে ভেতরের পকেটে রেখে দিল। তারপর দ্রুত রিক্সার কাছে ছুটে গেল। পাগলের মত রিক্সা চালাতে লাগলো সে বাড়ির পথ ধরে। আনন্দের ঢেউ তার চোখে-মুখে উৎসারিত হচ্ছিল।
সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই পারছিল না। রিক্সা তার চলছিল এঁকেবেঁকে। গলদঘর্ম শরীর, মুখ-ভরা হাসি, এক বুক আশা আর অন্তঃপকেটে পাঁচ লক্ষ টাকার চেকটি নিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে সে বাড়ির দিকে চালালো রিক্সা ঝড়ো বেগে। কিন্তু বাড়ির প্রায় নিকটে পৌঁছতেই সে দেখে সেখানেও তাকে বরণের জন্য আয়োজন করা হয়েছে। এক পরিচিত আগন্তুক তার অপেক্ষায় রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তাকে স্বাগত জানাতে। তার রিক্সা থেমে গেল।
পরদিন পত্রিকার ভেতরের একটি পাতায় ছোট একটি কলামে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সৌভাগ্যবান হামিদের নাম ছাপা হল রক্তিম আবিরে সুসজ্জিত ছবির সাথে।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।