বিবিধ

কৃষ্ণনগরে কাজী (চতুর্বিংশ পর্ব) [ধারাবাহিক]



ইনাস উদ্দীন


[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]

পর্ব - ২৪

সভাপতি দলের পক্ষে কী প্রস্তাব দিতে চলেছেন? জমির রায়তী স্বত্ব নিয়ে ছোটোলাটের সামনে কী প্রস্তাব তুলে ধরা হবে? কলকারখানায় শ্রমিকদের কাজের সময় এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে কিরকম দাবিপত্র থাকবে? এসেম্বলিতে কি সেসব প্রস্তাব আদৌ উঠবে? সভাপতি প্রস্তাবনা ঘোষণার কথা উল্লেখ করলে টাউন হল আবার টানটান উত্তেজনায় কান খাঁড়া করে নিঃশব্দ হয়ে উঠল।

আমাদের দেশের কৃষক সমাজের উন্নতির জন্য সহজ কোনো ফরমুলা নেই, সহজ কোনো প্রস্তাবনাও নেই। প্রতিটি পদক্ষেপেই জটিলতা থাকবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের বসে থাকলে কোনোদিনই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। তাই আমার প্রথম অনুরোধ, একসঙ্গে সবটা না পেলে তা নেব না, বর্জন করব, এরকম একবগ্গা ভাব থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে এটাই আমার প্রথম অনুরোধ বা প্রস্তাবনা যাহাই বলুন - নরেশ বাবুর বাকচাতুর্য প্রশংসনীয়, তিনি বিতর্কের গোড়া আগে থেকেই মেরে রাখছেন। বক্তব্য ঠিক দিকেই যে যাচ্ছে তা মঞ্চের নেতাদের প্রসন্ন মুখচোখ দেখেই বোঝা যায়।

সবার আগে, সম্ভবত সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে জমিতে প্রজার সম্পূর্ণ মালিকানা। তার জমিতে প্রজাস্বত্ব থাকবে, তার জমির গাছের ফল তার থাকবে। কিন্তু এই দাবি অত সহজে পূরণ হবার নয়। সেই কবে ১৭৯৩ সালে ইংরেজ শাসক জমির বন্দোবস্ত নিয়ে কী একটা চুক্তি করেছেন, তার জের এখনো চলছে। ভূস্বামী জমিদার ও নবাবগণ এখনো সেই চুক্তির কথা উল্লেখ করেন, আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। আমরা বলব - যারা জমি চাষ করে, জমি যাদের অধিকারে থাকে, তাদের তো কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। কৃষকদের বাদ দিয়ে বন্দোবস্তের চুক্তি হলো ব্রিটিশ শাসক কোম্পানি এবং জমিদারদের সাথে। কৃষক সমাজ সেই চুক্তি মানতে বাধ্য হবে কেন? ১৮৫৯ সাল থেকে মাঝেমধ্যে সেই ববন্দোবস্ত বিধির কিছু কিছু সংশোধন হয়েছে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই জোড়াতালি দেওয়া। যখনই কিছু হৈচৈ ওঠে, তখনই তালির উপর আবার খানিক জোড়াতালি দেওয়া হয়। এই সময় গভর্ণমেন্টের আবার কিছু ত্রুটি দূর করার জন্য ভাবনা এসেছে, আবারও কিছু জোড়াতালি দেবার উদ্যোগ চলছে।

প্রথমত কৃষক জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক হলে জমি বিক্রি করতে পারবে, কিন্তু তার জন্য জমিদারের অনুমতি প্রয়োজন এবং বিক্রয় মূল্যের শতকরা ২৫% জমিদারকে দিতে হবে। পাশাপাশি জমিদার কিংবা আংশিক মধ্যস্বত্বভোগী ইচ্ছা করলে সেই জমি নিজে খরিদ করতে পারবে। এই আইন বাহ্যত কৃষকের কল্যাণে বলে মনে হলেও বাস্তবে কৃষক জমিদারের অধীনস্হ হয়েই থাকতে বাধ্য হবে। আমরা জমিদারের অধিকারের বিপক্ষে নই, তারা এতোকাল যে সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করে আসছেন, সহসা সে অধিকার ত্যাগ করতে রাজি হবেন না। কিন্তু আমাদের দাবি, জমিদার তার প্রাপ্য খাজনা নিন, খাজনার মূল্যস্বরূপ ক্ষতিপূরণ নিন, কিন্তু তা ছাড়া জমির ভোগদখল ও ক্রয়-বিক্রয়ের উপর তাদের কোনো অধিকার যেন না থাকে।

পরের প্রস্তাবনা জমির উপর জন্মানো বা লাগানো গাছের বিষয়ে। জমিতে আগাছা হলে তা কৃষকের — এই মালিকানা সরকার দয়া করে প্রদান করেছেন। কিন্তু ফলের গাছ হলে শতকরা ২৫ টাকা জমিদারের। এই বিধি থাকা মানেই নানারকম বিতর্ক আর ঝুটঝামেলা। সেটি আদৌ আগাছা না ফলের গাছ, আদৌ কত দামে বিক্রি হলো ইত্যাদি নানান ঝামেলা আর মামলা চলবে। চাষির হয়রানি বাড়বে। আমাদের দাবি - এরকম অস্বচ্ছ আইন পরিবর্তন করা হোক।

তৃতীয় বিষয় হচ্ছে কৃষকের হাতে চাষের প্রয়োজনে এবং অবসর কালে বিকল্প অর্থের সংস্থান। গ্রামের কুটির শিল্পগুলিতে কৃষকের অবসর সময়ে কর্মের সংস্থান হতো। এখন কলু তেল তৈরি করেনা, তেল আসে কলকাতার কারখানা থেকে। পাটের দড়ি ও চটও কারখানায় তৈরি হয়। সুতরাং কৃষক কর্মহারা হয়ে পড়ছে। মহাত্মা গান্ধী খাদি বস্ত্র বুননের একটা বিকল্প দিয়েছেন বটে, কিন্তু তা সবার পক্ষে সম্ভব হয়না। আমাদের দাবি, সরকারের শিল্প দপ্তর উপযুক্ত সমীক্ষা করুক কোন এলাকায় কোন ধরণের কুটির শিল্প প্রসার লাভ করতে পারে। সেইসব স্থানে কৃষক সাধারণ ক্ষেতমজুর যাতে অবসরকালে কাজের সুযোগ পায় সেই চেষ্টা করতে হবে।

পরের বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ - তা হচ্ছে পাটচাষিদের দুরাবস্থা। চাষী পাট উৎপাদন করে, কিন্তু তার লাভ যায় মূলত বৃহৎ মহাজন এবং মাঝের দালালদের হাতে। যেহেতু অন্য কোনো বাজার নাই, সেই হেতু চাষির কাছে এর কোনো উপায় থাকেনা। এরজন্য একটিই বিকল্প, তা হচ্ছে পাটচাষিদের সমবায় গঠন করে সংঘবদ্ধ হওয়া। গ্রামে গ্রামে চাষিদের সমবায় প্রথায় জোটবদ্ধ হতে হবে। পাটের বিক্রয় সেখান থেকেই হবে। ক্রমশ অনেক গুলো কোওপারেটিভ মিলে পাটচাষিদের ফেডারেশন তৈরি করতে হবে। পাটের দর নির্ধারণ হয় বোম্বাই থেকে, সেই দামে চাষি পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আমরা যদি জোটবদ্ধ হয়ে কোওপারেটিভ মাধ্যমে ফেডারেশন গঠন করি, তাহলে আমরাই দরাদরি করতে পারব। এর জন্য গভর্ণমেন্টের যত না ভূমিকা, আমাদের নিজস্ব জোটবদ্ধতার ভূমিকা অধিক।

সভাপতির ভাষণ তুলনামূলক ভাবে যথেষ্টই দীর্ঘ। তবু হেমন্ত সরকার চেয়েছিলেন পার্টির বক্তব্যের অধিকাংশটিই সভাপতির ভাষণে আসুক, তাতে পরবর্তী আলোচনায় বিতর্ক কম হবে, সময় নিয়েও টানাটানি হবে না। নরেশ বাবু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তুললেন। গ্রামে শিক্ষার জন্য সরকারী বরাদ্দ বলতে তেমন কিছু নাই, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের হাতে সেই ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত। শুধু জমির স্বত্ব হলেই উন্নতি ঘটেনা, অন্তত খবরের কাগজ পড়ার মতো প্রাথমিক শিক্ষাটুকু তাদের পরিবারে দরকার। এই দাবিসমূহ ব্যবস্থাপক সভায় উত্থাপন করার জন্য সব দলের সদস্যদের নিকট আমাদের আহ্বান জানাতে হবে।

দাবির পাশাপাশি কৌশলী অথচ বিনম্র সুন্দর ভাষায় তিনি এই সভা থেকেই দেশের জমিদার এবং ভূস্বামীদের নিকট দেশের কল্যাণের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকারের আবেদন জানালেন। দেশবাসীর সবার স্বার্থে, সাধারণ জনমানুষের স্বার্থে ভূস্বামীগণ যদি কিছুটা ত্যাগস্বীকার করেন, তাহলে দেশের বিশাল এক জনতা উপকৃত হয়। ইংলণ্ডে কাফ্রি দাসদের মুক্ত করার সময় সেখানে ভূস্বামীগণ প্রভূত স্বার্থত্যাগ করেছেন। জাপানের মতো দেশ আজ উন্নত হয়েছে তার পিছনে সামুরাইগণের অপূর্ব ত্যাগ আছে। এখানে ভূস্বামীদের ত্যাগ বলতে মুখ্যত কৃষকের মনেভতার স্বত: বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান। ভূমির মালিকানা নিয়ে চাষির অনিশ্চয়তা থাকলে সে জমির উন্নতি ঘটানো, খাল বা বাঁধের ব্যবস্থা ঘটিয়ে সেচের ব্যবস্থা ঘটানো ইত্যাদি নিয়ে মোটেও আন্তরিক ভাবে আগ্রহী হবে না। কোওপারেটিভ প্রণালীও এমন কিছু সহায়ক হবে না।

বক্তব্য শেষে প্রজা সম্মিলনের নেতৃবৃন্দের প্রতি আবারও আহ্বান জানালেন - ধৈর্য হারানো চলবে না। ভূস্বামীগণ একদিনে স্বার্থত্যাগী উদার হয়ে যাবে সেটা প্রত্যাশিত নয়। অনুরূপভাবে গভর্ণমেন্টও সব দাবি পূরণ করে দেবেন সেটাও প্রত্যাশা করা যায়না। কিন্তু যদি অল্প পরিমাণেও দাবিসমূহ মান্য করে, সেই সুযোগকে অবহেলার প্রয়োজন নেই। আমাদের সসন্তুষ্টি হবে না ঠিকই, তবু সেটুকু গ্রহণ করে বাকির জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সভাপতির ভাষণ শেষ হলে হেমন্ত সরকার ডেলিগেটবর্গের মতামত আহ্বান করলেন। সভাপতির এতোটা আপোষ করা নরম আহ্বান কুতুবউদ্দিনের না-পছন্দ। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করলে হেমন্তবাবু কৌশলে ডেলিগেটগণের বক্তব্য আগে শোনার কথা বলায় তাঁর আপত্তি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে গেল। ডেলিগেটগণের সত্যিই বেশি কিছু বলার ছিলনা। তাঁরা এই বক্তব্যকে প্রায় সকলেই দলের বক্তব্যকে স্বাগত জানালেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দিলেন। পাশাপাশি লেবার স্বরাজ পার্টির নাম পরিবর্তন করে শ্রমিক-কৃষক প্রজা পার্টি হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব উঠে এলো। দেশের গরিষ্ঠ মানুষ মূলত কৃষকই। সবাই তুমুল হাততালি দিয়ে সেই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন।

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।