রিনিদিদিমণি চেষ্টা করলে অন্তত বেথুয়াতে বা সদর তেহট্টে আসতে পারত, চেষ্টা করেনি। চেষ্টা মানে তো টাকা আর যোগাযোগ। দর কষাকষি চলে দুই, তিন, চার লাখের। এমন অনৈতিক হবার শিক্ষা অমর হালদার সন্তানদের দেননি। একটা সুপারিশ করলেই পাশের গ্রামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাস্ট ক্লাস পাওয়া মেজো মেয়ের হাইস্কুলের চাকরিটা হয়ে যেত। সালটা ছিল ঊনিশ’শ সাতানব্বই। এস এস সির আগে পড়াশোনায় তুখোড় হলেও স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির দরবারে পার্টি লেবেলের সুপারিশ ছাড়া নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব ছিল। ইন্টারভিউয়ে ১ম ২য় ৩য় হওয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়ত না। ওঁর মেজোমেয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। শিক্ষকতা করার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হয়েছিল। পরে অবশ্য WBCS অফিসার হয়েছে। চরম অভাব-অনটনে অমর হালদার নিজের আদর্শে অটল ছিলেন। এমন দৃঢ়চেতা পিতার কন্যা যে রিনি! তেহট্ট সার্কেলের তিনটি স্কুলে বদলি হয়েছে। সবই ছিল প্রত্যন্তর গ্রামে। চাকরি পাবার পর বছর কুড়ি ধুলো-কাদার চার পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গেছে। পথের দুইধারে ঝোপঝাড়। বুনো ফুলের মধু সংগ্রহে মৌমাছির গুঞ্জন, বিভিন্ন বর্ণের প্রজাপতিদের ব্যস্ততা, কতরকমের পাখিদের ওড়াওড়ি, বিনা পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা ঔষধিগাছ, কীটপতঙ্গ ও কম চোখে পড়েনি। কুল, আম, জাম, কৎবেল, বনকাঁঠাল, খেজুর, তেঁতুল, গাবগাছ - পথচারিরা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জিড়িয়ে নিয়েছে। রাখাল-বাগাল, দুরন্ত বালকেরা তরতরিয়ে গাছে উঠে কাঁচা-পাকা ফল পেড়ে খেয়েছে; এসব দৃশ্য এখন চোখে পড়ে না। যাতায়াতের পথে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। গ্রামের এই ধুলোকাদার পথে চলার মধ্যে ছিল অন্যসুর। এখন দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার লোক খুব কম। টোটো-অটো পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। শখ হলেও পায়ে ধুলো-কাদা লাগার উপায় নেই। ওরা যখন পড়াশোনা করেছে রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। রাস্তাই বা ছিল কোথায়? কলমা ছাপানো জলে মাঠঘাট রাস্তা এক হয়ে যেত। জল সরে যাবার পর চওড়া আল ছিল চলার পথ। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেছে। শরতের নীল ঝকঝকে আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের খেলা !চোখ জুড়ানো কাঁচা-পাকা ফসলের কোলাজ - থমকে দাঁড়িয়ে গেছে রিনি। টোটোতে যাওয়ার সময়ও দেখতে পায়; কিন্তু টোটোওয়ালাকে থামতে বললে অন্য যাত্রীরা রিনিদিদিমণিকে পাগল ঠাওরাবে না? তাই বলতে পারে না।
স্কুল জীবনে দারিদ্রতা থাকলেও ছিল অফুরন্ত আনন্দ। সেই নির্ভেজাল নির্মল আনন্দ; বিষন্ন বিকেলে অথবা নিঝুম রাতে নয়ন সাগরের জোয়ার রুদ্ধ করে দেয়। সেই সময় নবমশ্রেণি থেকে স্কুলে মেয়েদের শাড়ি পরে যেতে হত। শাড়ি পরে বই-খাতা সামলে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া। ভীষণ সমস্যা হত বর্ষাকালে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রিনি পা ফসকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ায় বই খাতা কলম ছিটকে পড়ল। দলের সবাই হো হো করে হেসে উঠলেও, একজন গম্ভীর মুখে ছড়িয়ে পড়া বই-খাতা গুছিয়ে দিয়ে বলে উঠেছিল,
"একটু সাবধানে হাঁটতে পারো না! সবসময় তেজস্বিনীর মতো চলাফেরা। ভারি অহংকার তোমার।"
ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বান্ধবী বর্ণা বলে উঠে, "কাদা জল মেখে কিংভূতের মতো এই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবি? বাড়ি যাবি না? লাল তোকে কতকিছু বলে গেল কোনো উত্তর দিলি না? বোবা হয়ে গেলি?"
রিনি, বর্ণার কথায় ও কোনো উত্তর দিতে পারল না। বাবুদের বাড়ির ছেলেটি কী সব বলে গেল - শোনার পর থেকে সারা শরীর অবশ অবশ লাগছে। শেষে আর একটা কথা বলেছিল,
"নৌকাবাইচের দিন নৌকায় কাছাকাছি থাকবো।"
ও কেন কাছাকাছি থাকবে? থাকলেই বা কী হবে? পাড়ার ছেলে-মেয়েরা একটা নৌকায় করে বাইচে আসে। আর না-থাকলেই বা কী হবে!
"খুকি, কী ভাবছিস অত? ভেজা জামা-কাপড় ছেড়ে গা ধুয়েনে। বাচা মাছের ঝোল রেধেছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।"
মায়ের কথায়; ভাবনায় ছেদ পড়ল। বাচা মাছ রিনির খুব প্রিয়। সকালে ভেজা ভাত (পান্তাভাত) খেয়ে স্কুলে গেছে। খিদে পাওয়াই স্বাভাবিক। বাচা মাছের কথা শুনে খিদে চচ্চড়িয়ে বেড়ে গেল আরও। বারান্দায় বই খাতা রেখে ঘরে ঢুকে গেল পোশাক পাল্টাতে। কলমার বাচা মাছের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। আট দশ সেরের রুই, কাতলা, আড়, বোয়ালের থেকে বাচা মাছের চাহিদা কম ছিল না।
প্রভাদেবী মেয়ের ভিজে যাওয়া বই-খাতা উনুনের পাড়ে রেখে শুকিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যে থেকে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল। কলমা-জলঙ্গি একাকার হয়ে গেছে। হুড়মুড় করে জল ঢুকছে কলমা বিলে। জলে টইটুম্বল কলমা নদী হয়ে উঠল। অতীতে তো নদীই ছিল।মাঠঘাট জলে একাকার। আমন ধান লাফিয়ে লাফিয়ে জলের উপর মাথা তুলে দিলেও; পেকে আসা ভাদুরে আউশ ধান সব ডুবে গেল। চাষিদের মাথায় হাত। চাষিরা পাট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোমর সমান; হাঁটু সমান জলে পাট কেটে জমিতেই জাগ দিয়ে দিল। রাধানগর, রাধানগর কলোনী, ধাপাড়িয়া, ম্যাচপোতা, ধনঞ্জয়পুর, শিবপুর জলে ভাসছে।
এসে গেল বিশ্বকর্মা পুজো। এমন বিপদের দিনেও নৌকাবাইচ উদ্ যাপনের আয়োজনে কোনো খামতি ছিল না। এ গা, ও গা থেকে ধাপাড়িয়ায় নৌকায় করে মাতব্বরেরা এসে শলা-পরামর্শ করেছে। গত শতাব্দীতে ধাপাড়িয়ার জমিদারের জামাতা নৌকা বাইচের সূচনা করেন; সেই গাঁয়ের মানুষের মান থাকবেই। দশ গ্রামের নৌকা, বাইচে যোগ দেবে। এই নৌকার গড়ন আলাদা। চওড়া কম। ম্যাচপোতার বিয়াল্লিশ হাত লম্বা নৌকা সেজে-গুজে গ্রামবাসীদের নিয়ে রওনা দিয়েছিল ধাপাড়িয়ার কলমা বিলে। প্রথম থেকেই যোগ দিয়ে আসছে। মাটি দিয়ে ধাপ বেঁধে উঁচু করে বসবাস শুরু করে মানুষ। ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা গ্রাম তাই ধাপাড়িয়া। কলমার পাড় দিয়ে মেলা বসে গেছে। অনন্ত দশ গ্রামের মানুষ নৌকা করে বাইচ দেখতে আসে। আরোহীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আকাশ-বাতাস মুখরিত। কলমার তীরবর্তী মানুষদের বাঁধা গানের তালে জলে বৈঠা ফেলার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিশোর-কিশোরীরা মনের মানুষের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ে পুলক লুকাতে ব্যস্ত। আবীর, সাবির, আকবর-আকাশ, আশা-আয়েশা, রেখা-রেশমারা নৌকার খোলে বসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে পরস্পরের গায়। রিনি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ইতিউতি তাকাচ্ছে লাল কোথায়? তাদের নৌকা গন্তব্যে সবার আগে পৌঁছেছে। অসংখ্য মানুষের ভিড়। মাইকে ঘোষনা করা হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অর্জন করা বাইচ নৌকার। আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে রিনিদের নৌকায়। পেটা কাঁসার ঘড়া বাইচ কমিটির সভাপতি তুলে দিলেন অমর হালদারের হাতে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। অন্ধকার নামার আগেই সবাই নিজ গাঁয়ে ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিদ্যুতের আলো তখনও পৌঁছায়নি এ-সব অঞ্চলে। রাতের আঁধারে মানুষ বোঝায় নৌকাডুবি হলে বিপদের শেষ থাকবে না। বয়ষ্কদের তাগাদায় রিনিদের নৌকা ম্যাচপোতায় পৌঁছালো যখন, তখন ঘরে ঘরে মঙ্গল শঙ্খ বাজিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ তুলসি তলায় রেখে গ্রাম্যবধূরা প্রণাম করছে। ঘাট পিছল হওয়ায় যাত্রীদের নামতে সাহায্য করছে অন্যরা। রিনিকে নৌকা থেকে নামার সময় তার হাত ধরে নামতে সাহায্য করছে যে হাতটি; মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে লাল!
(ক্রমশ)